দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লেনিন চিসিম বুলুর এগিয়ে যাওয়া
কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
কলমাকান্দা উপজেলার ১২ কিলোমিটার উত্তরে খারনৈ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা লেনিন চিসিম বুলু। লেখাপড়া করেছেন হালুয়াঘাট বিরই ডাকুনী উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। কর্মঠ, উদ্যমী ও প্রাণচাঞ্চলে ভরা এই টগবগে তরুণ সবসময় বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করতেন। কাজের প্রতি তার অনেক আগ্রহ। কোনদিন নিজেকে অন্যের অধীন বা কারো করুণার পাত্র হিসেবে মেনে নিতে পারতেন না। নিজের সাধ্যমত পরিশ্রম করতেন হাতখরচা ও পরিবারের কিছু সাহায্য করার জন্য। কিন্তু এই উদ্যমী, কর্মঠ ও স্বাধীনচেতা মানুষ হঠাৎ করে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন! কিন্তু তারপরও থেকে নেই তাঁর উদ্যোগ।
লেনিন পরিবারের বড় ছেলে। তাই একসময় সে সংসারের হাল ধরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে তিনি আজ অন্ধত্ব জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, “আমার মা বাবা ভাই বোনদের কাছে নিজেকে বড় বোঝা মনে হচ্ছিল।” যাতে পরিবারে কারও বোঝা হিসেবে থাকতে না হয় তিনি উদ্যোগ নেন কিছু করার। স্বাধীনচেতা লেনিন চিসিম বুলু বাড়ির পাশের বিদ্যালয় মাঠের এক কোণায় বস্তা বিছিয়ে ১৫০ টাকার পুঁজি নিয়ে শুরু করেন বিস্কুট, চানাচুর ও চকোলেট এর দোকান। প্রতিদিন এভাবে সকাল থেকে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত বসেন দোকানে। তার ব্যবসা ভালো চলতে দেখে পরিবারের লোকেরা তার জন্য শিমুল গাছের নিচে একটা চাং বানিয়ে দেন। সেখানেই তার সারাদিন কেটে যায় এটা সেটা বিক্রি করে। তার আগ্রহ ও লাভ দেখে একসময় মন্ডলী (গির্জা) থেকে দোকান ঘর করার জন্য স্থান দেওয়া হয়। দোকান ঘর করে আরো মোটামুটি বড় পরিসরে দোকান দেওয়া শুরু করেন লেনিন। সেই দোকানের টাকা দিয়েই ছোট দুই বোনকে বিয়ে দেন। এক ছোট ভাইকে লেখাপড়া করান। আর এক ছোট ভাইকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দেন ভাড়া চালিয়ে কিছু আয় করার জন্য। এমন করেই তিনি তার সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে লেনিন এ ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। কেননা যে স্থানে আগে শুধুমাত্র দু’টি দোকান ছিল সেখানে বর্তমানে ৫টি দোকান হয়েছে। এছাড়া মাঝে তিনি বেশ অসুস্থ হওয়ায় বেচাকেনায় একটু ছেদ পড়েছে। তবে তিনি থামতে চান না। একটু সহযোগিতা পেলে তিনি আবার আগের মতো পুরোদমে ব্যবসা করতে পারবেন বলে জানান। তিনি বলেন, “আমি থেমে থাকতে চাই না, চাই না অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে। আমি ভাইবোনদের সাথে মিলে মিশে এক সাথে থাকতে চায়। কারো বোঝা হিসেবে নয়; পরিবারের একজন সদস্য হিসেবেই থাকতে চায়।
উল্লেখ্য যে, ২০০১ সালে তরমুজ ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করে পোকা দমন করেন লেনিন। প্রতিসপ্তাহে তিনি ২-৩ বার করে কীটনাশক স্প্রে করতেন। এভাবে সপ্তাহে ২-৩ বার করে কীটনাশক স্প্রে করতে করতে একসময় এক চোখে লাল হওয়া শুরু করে। একসময় দু’টি চোখেই সমস্যা দেখা দেয়। পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে আস্তে আস্তে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে যেটুকু সাহায্য পেয়েছিলেন সেটা দিয়ে ঢাকা ইসলামীয়া চক্ষু হাসপাতাল গিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন। পরীক্ষা শেষে ইসলামীয়া চক্ষু হাসপাতাল থেকে তাকে জানানো হয় অপারেশন করে আর কোন লাভ হবে না। কারণ তার চোখের কর্ণিয়া নষ্ট হয়ে গেছে।