হদয় কেন্দুয়া সংগঠনের উদ্যোগে বিনামূলে স্বাস্থ্য ক্যাম্প
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ, জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭% প্রবীণ (ষাটোর্ধ)। মোট জনসংখ্যার ৭% হিসেবে দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১১২,০০০০০ (এক কোটি বারো লাখ)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে নারীদের প্রায় ৭২ বছর ও পুরুষদের ৭০ বছর। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলশ্রæতিতে এদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৭.০ ভাগ প্রবীণ; যা ২০৩০ সালে ১১.৫% এবং ২০৫০ সালে ২১.৫% এ দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ক্রমবর্ধনশীল প্রবীণ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্য, পেশা, মর্যাদা, বিনোদন ও নিরাপত্তাসহ জীবনধারণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নানান ধরণের সমস্যার সন্মখীন হচ্ছে; যা ক্রমান্বয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে।
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, কিন্তু আমাদের পরিবারে ও সমাজের দরিদ্র এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের যেখানে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে গিয়ে অনেক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়, সেখানে তাঁদের নিরোগ রাখা বা স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার কেউ নেই।
নেত্রকোনা জেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের আশুজিয়া গ্রামের বিভিন্ন কলেজ, ভার্সিটি ও বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত যুবকদের উদ্যোগ গড়ে ওঠা ‘হৃদয়ে কেন্দুয়া যুব সংগঠন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনটি গ্রামের সার্বিক উন্নয়নে (প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু পরির্বতন মোকাবেলা ও পরিবেশ সুরক্ষা, প্রবীণ ব্যক্তি, শিশু, গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক পরামর্শ, বীজ সংরক্ষণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, প্রবীণদের নিয়ে গল্পের আসর) প্রায়শই বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। সংগঠনের উদ্যোগে আশুজিয়া ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী ১২টি গ্রাম পর্যায়ের দরিদ্র পরিবারের স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গ্রামে ও সমাজে দরিদ্র প্রবীণরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবহেলা ছাড়াও সামাজিকভাবে তারা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছে। অনেক পরিবারের প্রবীণ সদস্যগণ ঠিক মতো খাবারও পান না, স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা তো পরের কথা। অনেক প্রবীণ ব্যক্তি আবার পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে নিকট আত্মীয় বা প্রতিবেশিদের বাড়িতে।
গ্রাম পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে যুব সংগঠনের সদস্যরা এমনও কিছু পরিবার পেয়েছে, যেখানে পরিবারের গৃহপালিত প্রাণীদের জন্য যে পরিমাণ খাবার বরাদ্দ থাকে একজন প্রবীণ সদস্য’র জন্য তার কণামাত্রও থাকেনা। এ ধরণের পরিস্থিতির জন্য তারা অনেক কারণও খুঁজে পেয়েছে। কারণগুলো হল: পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রবীণ সদস্যদের প্রতি অবহেলা, পরিবারের অধিক সদস্য সংখ্যা, চরম দারিদ্রতা, পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকা, পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তন, সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে জনকল্যাণমূলক সেবার অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি।
প্রাপ্ত পারিবারিক ও সামাজিক অসংগতিগুলো হ্রাসকরণে ‘হদয় কেন্দুয়া যুব সংগঠন’ সমাজের সকল শ্রেণী, পেশা ও বয়সের জনগোষ্ঠীদের সম্পৃক্ত করে জাতি, ধর্ম, পেশা ও বয়সের লোকদেরকে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখার ইতিবাচক মানসিকতা তৈরির মাধ্যমে বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতা সংগঠনটি আশুজিয়া বাজারে সম্প্রতি সকলের জন্য বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিতকরণে একটি ‘বøাড গ্রæপিং ক্যাম্প’র আয়োজন করে।
বøাড গ্রæপিং ক্যাম্প কর্মসূচির উদ্বোধন করেন আশুজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নেত্রকোনা জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ আতিকুর রহমান। কর্মসূচি বাস্তবায়নে কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করেন কেন্দুয়া ‘সূর্যের হাসি ক্লিনিক’ এর দু’জন ল্যাব টেকনেশিয়ান ও প্যারামেডিক। গ্রামের প্রবীণ নারী ও পুরুষদের স্বাস্থ্য সেবা হিসেব রক্তচাপ, ওজন ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা শেষে শারীরিকভাবে অসুস্থ নারী-পুরুষ ও শিশুরা ক্যাম্পের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখিয়ে পরামর্শপত্র গ্রহণ করেন। যুব সংগঠনের পক্ষ থেকে দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে সামান্য ঔষধ বিতরণ করা হয়।
স্বাস্থ্য ক্যাম্পে সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুবাস চন্দ্র বলেন, ‘একজন সুস্থ মানুষ তিন মাস পরপর রক্ত দিতে পারে। রক্ত দিলে শারীরিক কোন ক্ষতি হয় না। তাই প্রত্যেক মানুষের নিজের রক্তের গ্রæপ সর্ম্পকে জানা দরকার। নিজের মধ্যে কারো সমস্যা হলে রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করা যায়। আমাদের প্রত্যেকে শরীরের রক্তে কিছু নির্দিষ্ট কনিকা থাকে। তিন মাস পরপর তা নষ্ট হয়ে পুনরায় জন্মায়। রক্তের ঘাটতি পূরণ করতে হলে প্রচুর পরিমাণে পানি, কচুশাক, ফলমূল, সবুজ শাকসবজি খেলে রক্তের কোন ঘাটতি হবেনা এবং সকলে সুস্থ্য থাকতে পারবেন।’
তিনদিন ব্যাপী স্বাস্থ্য ক্যাম্প’র ফলে আশুজিয়া ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের প্রায় ৭০০ জন রোগী নিজেদের রক্তের গ্রæপ সম্পর্কে জেনেছে এবং বিভিন্ন ধরণের রোগের চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ সহযোগিতা পেয়েছেন। ১২টি গ্রামের স্থানীয় যুব সংগঠন বিভিন্ন গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি, রোগীদের রেজিষ্ট্রেশন, শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও রোগীদের বিভিন্ন সমস্যায় সহযোগিতা করেন। হৃদয় কেন্দুয়া যুব সংগঠনের উদ্যোগে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচি সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রতিটি গ্রামেই কমবেশি যুব জনগোষ্ঠী রয়েছে। এসব যুব শক্তির অধিকাংশই শিক্ষার্থী এবং গ্রামে অলস সময় বসে কাটায়। এসব যুব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে গ্রামের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার কারা গেলে যেকোন গ্রামের উন্নয়ন অবধারিত। কিন্তু সকল এলাকায় এই যুব জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা সম্ভব হচ্ছেনা শুধুমাত্র উদ্যোগী নেতৃত্ব বা সংগঠকের অভাবে। ‘হৃদয়ে কেন্দুয়া যুব সংগঠন’র ন্যায় যুব নেতৃত্ব প্রতিটি গ্রামে আজ একান্ত প্রয়োজন। যুবদের সংগঠিত করে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে যুব শক্তিকে ব্যবহার করা গেলে যুব সমাজ মাদকাসক্তি, অসামাজিক, অনৈতিক ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখা সম্ভব। আর এটি করা গেলেই আমাদের গ্রামীণ জনপদ একদিন শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জনপদে পরিণত হবে। আমরা দেশের প্রতিটি গ্রামীণ জনপদে এরুপ যুব সংগঠনের স্বপ্ন দেখতেই পারি।