নগুয়া গ্রাম মানুষের কাছে প্রেরণা

 

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমি
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের নগুয়া গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের প্রাণান্তকর উদ্যোগে বদলে গেছে গ্রামের চিত্র। গ্রামের উন্নয়নে যৌথভাবে কাজ করার জন্য কৃষকরা গড়ে তুলেছেন ‘আশুজিয়া সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠন’ নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটি গঠনের পর থেকে বিগত কয়েকবছর ধরে এলাকার উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে আসছে। নিম্নে আশুজিয়া সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠনের সার্বিক উন্নয়নে গৃহীত কার্যক্রমগুলো ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হল:

গ্রামে ছিলনা কোন সংগঠন, কোন সংস্থা কাজ করতো না। বাল্যবিয়ে হতো গ্রামে। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে প্রায়ই। কৃষক বীজ সংগ্রহ করতেন বাজার থেকে। গ্রামে ফসলের পোকার জন্য অনেক বিষ ব্যবহার হতো। গ্রামে কোন তথ্য পাওয়া যেত না। নারীরা কোন অনুষ্ঠানে যোগদান করতে গেলে পুরুষ লোকেরা বাধা দিতো। নেত্রকোণা জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে কেন্দুয়া উপজেলার নগুয়া গ্রাম। হাওর বিল, নদীবেষ্টিত একটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রাম নগুয়া। ২১২টি পরিবার রয়েছে নগুয়া গ্রামে। কৃষি কাজই গ্রামের মানুষের মূল পেশা। সব মিলিয়ে বলতে গেলে পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম নগুয়া।

মালশিরা ধানে কৃষকের মন জয়
আমন ২০১৯ মৌসুমে আশুজিয়া ও পাড়াদূর্গাপুর গ্রামের কৃষকরা তাদের প্রায় ৩৫ একর জমিতে মালশিরা ধান চাষ করে বেশ লাভবান হয়। বিশেষভাবে উৎপাদন খরচ খুবই কম, সার বিষ খুবই কম লাগে, ফলন ভালো ও ওজন বেশি, ধান চিকন ও গাছ হেলে পড়েনা, খেতেও ভালো হওয়ায় অন্যান্য কৃষকরাও এর বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যান। আমন ২০২০ মৌসুমে আশুজিয়া গ্রামের অনেক কৃষক নিজেদের জমিতে রোপণের জন্য মালশিরা ধানের চারা উৎপাদনের পাশাপাশি বিক্রির জন্যও চারা উৎপাদন করেন। উৎপাদিত মালশিরা ধানের চারা নিজেদের জমিতে রোপণের পর পার্শ্ববর্তী গ্রাম পাড়াদূর্গাপুর, নগুয়া, রাজিবপুর, কছনধারা এবং পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন মদনপুর এর মনাংসহ বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের নিকট বিক্রি করেন। এবছর বন্যায় অনেক এলাকার কৃষকদের ধানের চারা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা চারা কিনে নিয়ে জমিতে চাষ করেন। মালশিরা দেরিতে রোপণ করলেও ভালো ফলন পাওয়া যায় এবং ৮/১০ দিন পানিতে ডুবে থাকলেও নষ্ট হয় না এসব বিষয় জানার পর অন্য গ্রামের কৃষকরা মালশিরা ধানের চারা কিনে নিয়ে নিজেদের জমিতে চাষ করেছেন।

নগুয়া গ্রাম এখন বাল্য বিবাহমুক্ত
এই গ্রামে কোন বাল্যবিয়ে হয়না এখন। গ্রামের নারী ও পুরুষ যুব মিলে গড়ে তুলেছেন একটি অনন্যা দল, যে দল কোথাও বাল্যবিয়ে হলে প্রশাসনকে খবর দিয়ে দেন। গত তিন বছরে ৪টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে পেরেছেন গ্রামের কৃষক যুবক মিলে।

বীজের সমস্যা দূরীকরণে গ্রামীণ বীজঘর স্থাপন
আশুজিয়া ও নগুয়া গ্রামের কৃষকরা সারাবছর বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন করে চলেছেন। মানসম্মত সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসলের বীজের সমস্যা লাঘবে সংগঠনের উদ্যোগে নগুয়া গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে একটি গ্রামীণ বীজঘর। নগুয়া, আশুজিয়া, সিংহেরগাও, বলাইশিমুল, বান্দলাল, ভুগিয়া, রামপুর ও রেইন্ট্রিতলাসহ ১১টি গ্রামের মানুষ এবছর বীজঘর থেকে ধান ও সবজির ১৩ জাতের বীজ নিয়ে জমিতে চাষ করেছেন। কৃষকরা চলতি আমন মৌসুমে বীজঘর থেকে তিন জাতের ধানের বীজ (মালশিরা, চিনিশাইল ও সুবাশ) ১৮ জন কৃষকের মধ্যে বিতরণ করেছেন। এছাড়াও আসন্ন শীত মৌসুমে চাষের জন্য গ্রামের ৫৪ জন কৃষক-কৃষাণী পাঁচ জাতের সবজি বীজ (লাউ, সীম, লালশাক) বীজঘর থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। বীজঘরের তত্ত্বাবধায়ক কৃষাণী রোকেয়া বেগম চলতি মৌসুমে বসতভিটায় ৮ জাতের শিম চাষ করেছেন। গ্রামীণ বীজঘর স্থাপনের ফলে কৃষকদের মানসম্মত বীজের সমস্যা অনেকটা লাঘব হয়েছে।

নিম গ্রাম গড়ার উদ্যোগ
নগুয়া গ্রামকে নিম গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে নগুয়া সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠনটি প্রতিবছর বৃক্ষ রোপণের মৌসুমে গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবারে এবং গ্রামের রাস্তার ধারে ও পতিত স্থানে নিমের চারা রোপণ করে চলেছেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন সংকটেও সংগঠনটি নিমের চারা রোপণ করতে ভুলেনি। প্রতিবছর নিমের চারা রোপণের ধারাবাহিকতায় সাংগঠনিক উদ্যোগে গ্রামের বিভিন্ন বসতভিটা, পতিত জায়গা ও রাস্তার ধারে ১০২টি নিমের চারা রোপণ করা হয়েছে। এ নিয়ে বিগত তিন বছরে সংগঠনটি গ্রামে ৫৩২টি নিমের চারা রোপণ করেছেন। তিন বছর পূর্বে গ্রামের রাস্তায় রোপণকৃত নিমের চারা বর্তমানে ৮-১০ ফুট লম্বা হয়েছে। যে নিমের ডাল দিয়ে গ্রামের মানুষ দাঁত মাজে, পোকা দমনে ঔষধ তৈরি করেন।

জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন

নগুয়া গ্রামের কৃষকরা পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আসছেন। নেত্রকোনা সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর কম্পোস্ট গ্রাম পরিদর্শন করে সংগঠনের সভাপতি কৃষক আবুল কালাম কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন ও বালাইনাশক তৈরির পদ্ধতি জেনে এসে নিজে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে ও জৈব বালাইনাশক তৈরি করে জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করছেন। কৃষক আবুল কালামের জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রম দেখে গ্রামের অন্য কৃষকরাও এতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। গ্রামের ৬ ছয়জন কৃষক ভার্মিকম্পোস্ট চাষ ও ব্যবহার করছেন।

ফসলের হাসপাতাল চালুর মাধ্যমে কৃষি সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা

কৃষকেরা গ্রামে গড়ে তুলেছেন ফসলের হাসপাতাল। যেখানে কৃষক শস্যফসলের রোগবালাইয়ের প্রাকৃতিক সমাধান দিয়ে থাকেন। জৈববালাইনাশক ও জৈবকৃষি চর্চার পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ফসলের এসব রোগ-বালাইয়ের কিছুটা কৃষকরা নিজেরা সমাধান করতে পারলেও অনেক সমস্যা সমাধান করতে পারেন না। তবে গ্রামের বেশকিছু অভিজ্ঞ কৃষক রয়েছেন, যারা ফসলের অনেক রোগ-বালাইয়ের সমাধান জানেন। আশুজিয়া কৃষক সংগঠনের সভাপতি কৃষক আবুল কালাম গ্রামের অভিজ্ঞ কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে বিগত কয়েক মাস যাবৎ মাসে দু’দিন করে ফসলের হাসপাতালে ধানসহ কৃষকদের চাষকৃত বিভিন্ন ফসলের রোগবালাই ও কৃষি সমস্যার সামাধানে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। যেসব সমস্যার সমাধান তাদের মধ্যে কারো জনা নেই, সে সব সমস্যা ফোনে কৃষি কর্মকর্তাদের জানিয়ে সমস্যার সমাধান জেনে ভূক্তভোগী কৃষকদের জানিয়ে দেন।

ধানের জাত বাছাই
বাজারে চিকন ও সুগন্ধি ধানের বাজার মূল্য ও চাহিদা সব সময়ই বেশি থাকে। তাই যে সকল কৃষকদের কৃষি জমি বেশি, তারা খোরাকের ধানের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু জমিতে মাঝারি বা মোটা ধান চাষ করেন এবং বাকি জমিতে বাজারে বিক্রির জন্য সুগন্ধি বা চিকন ধানের চাষ করে থাকেন। নগুয়া ও আশুজিয়ার কৃষকরা মালশিরা, ঋতুপাইজাম, সুবাস, সোহাগ-৪, তুলসিমালা, পাঁচ জাতের ধান এলাকার জন্য উপযোগি বলে নির্বাচন করতে সক্ষম হন। নির্বাচিত এই পাঁচটির জাতের মধ্যে মালশিরা ধানটি সবচেয়ে বেশি কৃষকরা পছন্দ করেছেন। প্রতিবছরই ধানের জাতগবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে নতুন নতুন পছন্দের ধান বাছাই করছেন।

পাখির নিরাপদ বাসস্থানের জন্য গাছে মাটির হাড়ি বাঁধা
কোন ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে ফসলের পোকা দমনে গ্রামে পাখি প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাখির নিরাপদ বাসস্থান ও আশ্রয় নিশ্চিত করতে সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামের গাছে গাছে মাটির কলস বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফসলের জমিতে কৃষকরা বাঁশের কঞ্চি ও গাছের ডাল পুঁতে পার্চিং করে দিয়েছেন। কৃষদের মতে, পাখি ক্ষেতের পোকা খেয়ে ফসল রক্ষা করবে এবং পাখি বৈচিত্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রামের পরিবেশও সুরক্ষিত হবে।

নগুয়া গ্রামটি এখন কৃষি, পরিবেশ, বৈচিত্র্যময় ও পারস্পারিক ও আন্তঃনির্ভরশীল একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। এ গ্রামের সকলে এখন সংগঠিত। বিভিন্ন সমস্যা, বিপদে আপদে তারা ব্যক্তি ও সাংগঠনিকভাবে পরস্পরের পাশে দাঁড়ান। এ গ্রামের মানুষের মন সকল প্রতি প্রতি সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল।

happy wheels 2