হলুদ বরণে সেজেছে মানিকগঞ্জের ফসলের মাঠ : ৬০ লাখ টাকার মধু আহরণে ব্যস্ত মৌচাষীরা

আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ থেকে
দিগন্ত জোড়া মাঠের যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ রঙের মাখামাখি। যেন হলুদিয়া বরণে সেজেছে মানিকগঞ্জের ফসলের মাঠ। হলুদিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরে ওঠে মন। এছাড়াও জেলায় প্রায় ৬০ লাখ টাকা মূল্যের প্রায় ৪০ টন মধু সংগ্রহ হবে, এমন আশাবাদ মৌচাষী ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। মানিকগঞ্জের কৃষকরা বুঝে গেছেন মৌমাছি মধু সংগ্রহ করলে পরাগায়নের মাধ্যমে ফসল ভালো হয়। তাই মৌসুমী মৌচাষীরা আসায় জেলায় সরিষার ফলন বৃদ্ধি পাবে প্রায় ১৫ শতাংশ ।

মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরিষা আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মৌসুমী মৌচাষীদের তৎপরতা। সরিষা যেমন দিচ্ছে তৈল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া সরিষা চাষে রয়েছে দিগুণ লাভ। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য এর ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি করা হয় জৈব সার। ফলে মানিকগঞ্জ জেলার অনেক কৃষকেরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে ঝুকে পড়ছে।
01
ঘিওরের রাধাকান্তপুর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মুন্নাফ মিয়া জানান তার আবাদী ৩ একর জমিতে সরিষা আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। গত ১০ বছর যাবত আবাদযোগ্য জমিতে সরিষা চাষ করে প্রতি মৌসুমে ২০/৩০ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত লাভ করে আসছেন। চলতি মৌসুমে সরিষার ফলন ভালো হলে আরো বেশি লাভের আশা করছেন তিনি। বানিয়াজুরী  ইউনিয়নের রাথুরা গ্রামের কৃষক মোঃ কবির জানান, ভালো বীজ সনাক্ত করে সঠিক সময়ে বীজ রোপণ করলে এবং বিভিন্ন প্রকার সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে আগাম ফলন ফলিয়ে তা বাজারজাত করতে পারলে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অধিক লাভ করা সম্ভব হবে। এক বিঘা সরিষা চাষ করতে খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে বিঘায় ৪-৫ মণ সরিষা উৎপাদন হয়। প্রতিমণ সরিষার বাজার মূল্য ১৫-১৮ শত টাকা। অন্যান্য ফসল চাষ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমাণ লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ করে দিগুণ লাভ করা যায়।

এদিকে সরষের হলুদ ফুলের সা¤্রাজ্যে মাঠে মাঠে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৌ চাষীরা। জেলার বিভিন্ন এলাকা সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাতক্ষিরা, জামালপুর, গাজীপুর, পাবনা, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় শতাধিক মৌ চাষীর দল মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরষে ফুল থেকে বিশেষ কায়দায় মধু সংগ্রহ করছে। তাদের সংগৃহীত এই মধূ রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্রি করে থাকে।
2
বছরের নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সরষে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ চলে। এসময়ে গড়ে একেকজন মৌ চাষী প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ মণ মধু আহরণ করতে পারেন। চলতি বছর জেলার বিভিন্ন স্থানে মৌচাষীরা সরিষা ফুল থেকে প্রায় ৩৫ টন মধু সংগ্রহ করবেন, যার পাইকারী মূল্য ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা।

সাতক্ষিরা থেকে আসা মৌচাষী সাইফুল ইসলাম বারসিক নিউজকে জানান, ৪ বছর আগে তিনি ২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪০টি বাক্স নিয়ে মৌমাছির মাধ্যমে মধ ুসংগ্রহের কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তার বাক্সের সংখ্যা শতাধিক। সরিষা ফুল থেকে তিনি মাসে ২০-২৫ মণ মধু সংগ্রহ করছেন। তিনি এই মধু ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় পাইকারী বিক্রি করেন।
man
ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশেই সরষে ক্ষেতে মধু সংগ্রহের সরঞ্জাম নিয়ে বসেছে জামালপুর জেলার মো. সেলিম ও শফিকুল ইসলাম। তারা জানান, মধু সংগ্রহ করে তাদের সাবলম্বী হওয়ার কাহিনী। তাদের বাক্সেও সংখ্যা একশোর কাছাকাছি। প্রতি মণ মধু ৮-১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন ঢাকার যাত্রাবাড়ি ও আশুলিয়ার এক পাইকারের কাছে। নারায়ণগঞ্জের কুমুলী ইউনিয়নের মৌচাষী দলের প্রধান মো. জসিম উদ্দিন জানান, উন্নত প্রশিক্ষণ আর সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মধু সংগ্রহের কাজে ব্যাপক উন্নয়ন করা সম্ভব। তিনি আরো জানান, দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি  রফতানী করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

ঘিওর উপজেলার কৃষি অফিসার কৃষিবিদ আশরাফ উজ্জামান জানান, এ এলাকার জমি বেলে, দোঁআশ হওয়ায় পানি ধারনের ক্ষমতা কম। পানি ধারণ ক্ষমতার জন্য জমিতে জৈব সারের প্রয়োজন। সরিষা চাষ করলে খাবার তৈলের চাহিদা পূরণসহ পাতা ও ফুল ঝরে জৈব সার তৈরি করে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর  উপপরিচালক মো. আলীমুজ্জামান মিয়া  বলেন, “মানিকগঞ্জে এবার প্রায় ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৮৮ হাজার মেট্রিকটন। সরকার বারি ১৪ জাতের বীজ সরবরাহ করায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। জেলায় ৩৫ টন মধু সংগ্রহ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।” তিনি আরো বলেন, “মৌচাষীরা আসায় ফলন  প্রায় ১৫শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না ফসলের জন্য  ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহয়তা করে থাকে।”

happy wheels 2