কাঠুরিয়া সিরাজ উদ্দিনের জীবন সংগ্রাম
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
মানুষকে প্রতিনিয়ত চাল, ডাল, নুন, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও কাপড় চোপড় ওষুধ পত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে হয়। তাই জীবনের প্রয়োজনেই কাজ করতে হয় মানুষকে। প্রত্যেকেই কোন না কোন পেশাকে আশ্রয় করে অর্থ উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পেশাজীবীদের যোগ্যতা অনুযায়ী কেউ কেউ অধিক আয় করেন আবার কেউ কম আয় করে থাকেন। অপেক্ষাকৃত কমযোগ্যতা সম্পন্ন ও কম আয়ের পেশাজীবী মানুষদের হাড় ভাঙ্গা খাটুনী করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এমনই একজন মানুষ পাবনার চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের দোলং গ্রামের সিরাজ উদ্দিন। তিনি পেশায় একজন কাঠুরিয়া। প্রায় ত্রিশ বছর যাবত অন্যের বাড়িতে কাঠ (খড়ি) চেড়াই করে অর্থ উপার্জন করে পরিবার পরিজন নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
সিরাজ উদ্দিন (৬০) বলেন, “সারাদিন কুড়ালটি কাঁধে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। যখন কেউ খড়ি চেড়াইয়ের জন্য ডাকে তখন তার বাড়িতে গিয়ে খড়ি চেড়াই করি। বড় বড় গাছের গুড়ি, ধরণা, ডাল ফাড়াই করতে হয়। খুব পরিশ্রম হয় কিন্তু সে তুলনায় টাকা পাই না। ঘুম থেকে উঠে কিছু খেয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পরি। কোন দিন কাম হয় কোন দিন হয় না। কাঠ চেড়াই করার সময় পরনের লুঙ্গি ঘামে ভিজে যায়। তখন গামছা পড়ে লুঙ্গি খুলে চিপে আবার উল্টো করে পরি। এত কষ্টের কাম করি।” তিনি আরও বলেন, “গত তিরিশ বছর যাবত একটানা এ কাজ করে আসছি। সারাদিন করার মত কাজ পেলে সেদিন তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা পাই। দশ বারো দিন আগে একটা বড় কাম পাইছিলাম। তখন চার দিনে ৩৮ মণ খড়ি চেড়াই করে ১২ শ’ টাকা পাইছিলাম।” এ কাজের বর্ণনা দেওয়ার সময় তার চোখে মুখে ছিল উচ্ছাস।
কৃষ্ণ বর্ণের পাকা চুল খোঁচা খোঁচা গোফ দাড়ির অধিকারী সিরাজ উদ্দীনের এক ছেলে তিন মেয়ে। প্রায় ২৫ বছর আগে একটি গাভী বিক্রি করে তিন হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বড় মেয়ে সামান্য লেখাপড়া জানা শিরিনকে বিয়ে দেন। অভাবের সংসার হেতু মেজ মেয়ে মাহফুজাকেও পড়াতে পারেননি। ছোট বেলাতেই পেটের ভাত কাপড়ের জন্য মাহফুজাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে। পরে দশ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে এ মেয়েটিকে বিয়ে দেন তিনি। তৃতীয় মেয়ে শীলা সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর আর পড়ালেখা করাতে পারেননি তিনি। এ মেয়ের বিয়েতেও চল্লিশ হাজার টাকা যৌতুক দিতে হয় তাকে। বিয়ের অনুষ্ঠান করতে পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হয়। এ পঁয়ষট্রি হাজার টাকার যোগান দিতে পাঁচ শতক জায়গা বিক্রি করেন তিনি। চতুর্থ সন্তান জাহিদ কাজ করছে রাজ মিস্ত্রির জোগান দারের। ছোট দুই মেয়ে স্বামীর সংসারে আছে। বড় মেয়ে বিধবা। সময় অসময়ে তাকে সামান্য কিছু খরচ দিতে হয়। এ ছাড়া নিজের স্ত্রী ও ছেলেসহ তিন জনের সংসার পরিচালনা করতে হয় সিরাজ উদ্দীনকে।
সিরাজ উদ্দিন আরো বলেন, “বাড়ির পাশে ছোট আকারের একটি হাজা মজা পুকুর ছিল। সেটি ভরাট করতে বেসরকারী সংস্থা থেকে ৫২ হাজার টাকা ঋণ তুলেছি। ছেলে কাজ করে সপ্তায় এক হাজার দুইশ’ টাকা কিস্তি দেয়। ছেলের উপার্জনের টাকা কিস্তি দিতেই চলে যায়। কোনদিন মাছ শাক কিনতে পারি কোন দিন পারি না। এ ছাড়া ওষুধপত্র, কাপর চোপড়, চাল ডাল নুন তেল বিদ্যুৎ বিল আরো কত কি যে লাগে! দৈনিক অন্তত দুই তিনশ’ টাকা সংসার খরচ। কোন জমা জমি নাই আমার। আমি কাঠ চেড়াই করে যা কামাই করি তা দিয়ে কোন মতে নুন ভাতে দিন চলে যাচ্ছে।”
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় শহর ও গ্রামের উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা এখন ইলেকট্রিক রাইস কুকার, রুটি মেকার ব্যবহার করছেন। অনেক শহরের মানুষ গ্যাসের চুলায় রান্না করেন। কাঠ খড়ির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামের অনেক মানুষই এখন আর খড়িতে রান্না বান্না করেন না। গ্রাম এলাকার কিছু বাড়িতে, মফস্বলের কিছু হোটেল রেস্তোরায় কাঠ বা খড়িতে রান্না হয়। এসব বাড়ি ও হোটেল রেস্তোরায় এখন খড়ি চেড়াইয়ের কাজ করেন সিরাজ উদ্দিন। কেবল সিরাজ উদ্দিন নয় চাটমোহরের ভাদড়া গ্রামের হযরত আলী, দোলং গ্রামের আফসার আলী ও আসাদুল, জবেরপুর গ্রামের হাফিজুর রহমানসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার কিছু মানুষ এখনো এ পেশাটিকে আকড়ে ধরে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছেন।