রিজিয়ার জীবন সংগ্রামের গল্প

সাতক্ষীরা থেকে মহিরঞ্জন মন্ডল

উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাঠী গ্রাামে একটি অসহায় ও হত দরিদ্র পরিবার রিজিয়া খাতুনের (৩৫)। দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে অভাবের সংসারে দিন কাটে তাঁর। তাঁর স্বামী দিন মুজুরের কাজ করেন। বছরের সব সময় কাজ হয় না তার এজন্য অন্যের মাছের ঘেরে কৃষি দিনমজুর হিসাবে বছরে দুই থেকে তিন মাস কাজ করতে পারেন তাঁর স্বামী রবিউল ইসলাম (৪২)। বাকি সময় বাড়ীতে বেকার বসে থাকতে হয়। রিজিয়া খাতুন নিজে অসুস্থ, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে তাঁর। বাড়ির গৃহস্থালির কাজ ছাড়া তেমন কোনো ভারী কাজ করতে পারেন না তিনি। বড় মেয়েটার বয়স ১৬ বছর, ছেলেটার বয়স ৯ বছর। এর মধ্যে রিজিয়া খাতুনের কোলজুড়ে আসে আরেকটা মেয়ে সন্তান। ফলে এমনিতেই অভাবের সংসার তার উপর এতোগুলো মানুষের খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হয় রিজিয়া খাতুনের। এরকম পরিস্থিতিতে রিজিয়া খাতুন ও তার পরিবার যখন পুরোপুরি দিশেহারা ঠিক তখনই যুক্ত হয় বারসিক’র সাথে।


পিআরএ মাধ্যমে বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বকুল সিএসও দলের সদস্য হিসেবে যুক্ত হন রিজিয়া খাতুন। তিনি প্রতি সপ্তাহে গ্রুপ মিটিং এ হাজির হতে থাকেন এবং একটা পর্যায়ে জলবায়ু সহনশীল কৃষি চর্চা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রাণীসম্পদের লালনপালন, পরিচর্যা ও বসত ভিটায় যে সামান্য জায়গা রয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে সবজি চাষ করতে হয় সে বিষয়ে জানতে পারেন। রিজিয়া খাতুন তার পরিবারের সাথে পরামর্শ করে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসাবে সেলাই মেশিন ও ছাগল পালন করার সিদ্ধান্ত নেন। নেটজ্ বাংলাদেশের সহায়তায় বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের মাধ্যমে একটি সেলাই মেশিন নেন ও ২টি ছাগল সহযোগিতা পান তিনি। বারসিক থেকে পাওয়া ছাগলগুলো তিনি তার নিজের সন্তানের মত যতœ করে লালন পালন করেন। সাপ্তাহিক গ্রুপ মিটিং এ এসে তিনি জানতে পারেন যে নিয়ম মত ভ্যাকসিন দিলে ও কৃমির ঔষধ খাওয়ালে ছাগল অনেক ভালো থাকে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক কমে যায়। ফলে তিনি বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের প্যারাভেট কর্মী সোনিয়া আক্তারের নিকট থেকে ভ্যাকসিন দিয়ে নেন তার ছাগলগুলোকে। বর্তমানে তার সঠিক পরিচর্যার ফলে তার ২টি ছাগল ৪টি বাচ্চা দিয়েছে। বর্তমানে তাঁর ছাগলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬টিতে।

রিজিয়া খাতুন যে সেলাই মেশিন নিয়েছিলেন সেটি থেকেও ভালোই আয় হতে থাকে। অদম্য সংগ্রামী রিজিয়া খাতুন তার স্বপ্নটাকে ধীরে ধীরে বড় করতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, তার সন্তানদেরকে ভালো স্কুলে পড়াতে গেলে, আরো ভলো রাখতে হলে তার আয়টাকে আরো বাড়াতে হবে। তিনি তার সামগ্রিক আয় থেকে একটু একটু করে সামান্য কিছু টাকা সঞ্চয় করেন এবং ২টা ছাগল বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে পাখিমারা ফেরীঘাটে একটা ভাজার (চপ, পিয়াজু, বেগুনি, রুটি ডাল ইত্যাদি তৈরির দোকান) দোকান দেন। সেখানে তার বেকার স্বামীরও কাজের ব্যবস্থা হয়। স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে সেখানে সকালের নাস্তা, পরোটা, ডাউল এবং বিকালের নাস্তার জন্য সিংয়াড়া, সামোচা, চপ, বেগুনি ইত্যাদি বানান। রিজিয়া খাতুন ও তার স্বামীর অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের দোকানের বেচা বিক্রি খুব ভালোই চলে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মত আয় করতে পারছেন বলে তারা জানান। তারা এখন নতুন করে স্বপ্ন বুনছেন তার এই ব্যাবসাটাকে কিভাবে আরো বড় করা যায়, চিন্তা করছেন বসবাসের ঘরটি নতুন করে মেরামত করে দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে যাতে টিকে থাকতে পারে সে জন্য ঘরের ভিটটা অন্তত পক্ষে পাকা করবেন এবং ছেলে মেয়েকে ভালোভাবে পড়ালেখা করাবেন, সংসারে পুরোপুরি স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবেন।

বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়ে পাল্টে গেছে রিজিয়া খাতুনের জীবনের মোড় নতুন রূপ নিয়েছে। তাঁরা এখন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। রিজিয়া ও রবিউল দম্পতি এখন অনেক খুশি। বারসিক এবং নেটজ্ বাংলাদেশের প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “বারসিক থেকে আমি নানা ধরনের সম্পদ ও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ পেয়ে আমরা নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছি।’ রিজিয়া’র জীবন সংগ্রামের গল্প উপকূলীয় নারীদের জন্য এক জীবন্ত উদাহরণ।

happy wheels 2

Comments