গাছ কেটে সাবার হয়,বজ্রপাতে জীবন যায়

রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম

বহুবৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমি। নানা মূখী উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে উন্নতি হচ্ছে তার অর্থনীতির ভিত। তবে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর নানামূখী উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিরূপ প্রভাবও দেখা মিলছে এই অঞ্চলে। দিনে দিনে বরেন্দ্র অঞ্চলের জনজীবনসহ প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশরও ক্ষতির শিকার হচ্ছে। নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্যে দিয়েও নিজের সম্ভাবনা আর শক্তি কাজে লাগিয়ে সামালে নেন গ্রামের মানুষগুলো। অনেক কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার  করেও উৎপাদন করেন আমাদের জন্যে খাদ্য। চলমান সময়ের নানামূখী প্রাকৃতিক দুর্যাগগুলোর মধ্যে অন্যতম বজ্রপাত। বজ্রপাতে তাৎক্ষণিক মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণহানি হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসেবে স্থানীয় মানুষের ধারণা এবং করণীয় দিকগুলো নিয়ে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

lightning_24183
বজ্রপাত চলমান সময়ের অন্যতম একটি বড় প্রাকৃতিক দূর্যোগ। দেশব্যাপী এই দূর্যোগের আঘাতে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণহানি হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলেও বজ্রপাতের হার বেড়ে গেছে। বজ্রপাত সংঘটনের বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে স্থানীয় মানুষ কারণ হিসেবে গাছপালা কমে যাওয়াকেই বেশি দায়ি করেন। একই সাথে অভিজ্ঞজন মনে করেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় প্রচুর তাল, খেঁজুর এবং বড় বড় বট পাইকড়সহ নানা জাতের গাছের বৈচিত্র্য ছিলো। দিনে দিনে এসব কমে যাবার ফলে বজ্রপাতের সংঘটনের হার বেড়েছে। যদিও অনেকে জানান যে, বজ্রপাত আগেও ছিলো এখনো আছে। তবে গাছপালা কমে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগে জলাভূমিগুলো কমে যাবার কারণে বজ্রপাত সরাসরি প্রাণের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে। যার ফলে বজ্রপাতে প্রাণহানি হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নাচোল উপজেলার কসবা ইউনিয়নের খড়িবোনা গ্রামের প্রবীণ মৎসজীবী মো. আব্দুল খালেক বলেন, “প্রকৃতির উপর আমরা যেভাবে হাত খেলাচ্ছি এর ফলে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। খেঁজুর ও তাল গাছগুলো দেদারসে কেটে ফেলছি। এই কারণে বিজলি সরাসরি মানুষ প্রাণীর উপর পড়ছে।” তিনি আরো বলেন, “বজ্রপাতের কারণে গবাদি পশুসহ বন্যপ্রাণী এবং পশু পাখিও মারা পড়ছে।” রাজশাহীর পবা উপজেলার বিলনেপাল পাড়া গ্রামের প্রবীণ মো. মুরাদ আলী  বজ্রপাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে আধুনিক জীবন ব্যবস্থাকেও দায়ি করেন। তিনি বলেন, “আগের এতো বেশি টিনের আর লোহার ব্যবহার হতোনা। সবার বাড়ি টিনের এবং নানা কাজে লোহার ব্যবহার বেড়ে গেছে। এর ফলে বিজলী সরাসরি এই জিনিসগুলোর উপর আকর্ষণ করে।” একই গ্রামের প্রবীণ ও অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক মো. আসাদ অসচেতনতার কারণে বজ্রপাতে প্রাণের ক্ষতি বেশি হচ্ছে বলে দায়ি করেন। তিনি বজ্রপাতে করণীয় দিক হিসেবে বাইরে বের না হওয়া, বড়গাছের নীচে না থাকা, লোহার জিনিস থেকে দুরে থাকা এবং উন্মুক্ত প্রান্তে না থাকা, জলের উপর না থাকা বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। চৈত্র্য থেকে আষাঢ মাস পর্যন্ত ঈষাণ কোনে মেঘ দেখলে নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

IMG_20170406_171917-1
রাজশাহীর তানোর উপজেলার প্রবীণ কৃষক লুপ্ত ধানের রক্ষক ও জাতীয় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত কৃষক মো. ইউসুফ আলী মোল্লা লোকশ্লোক দিয়ে বলেন, “গাছ কেটে হচ্ছে সাবার হয়, বজ্রপাতে জীবন যায় ” তিনি মনে করেন, গাছপালা আর পরিবেশ নষ্ট করার কারণেই বজ্রপাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলের বড় বড় গাছগুলোকে যতœ করা, প্রশাসন থেকে এসব গাছের দেখভাল করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। অন্যদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের তাল আর খেঁজুর গাছ কাটা বন্ধ করতে এই অঞ্চলের জন্যে আইন তৈরি ও প্রয়োগের কথা বলেন।

বাংলাদেশ সরকারের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন তথ্য উপাত্তসহ স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে কিছু করণীয় দিক সম্পর্কে জানা যায়। নি¤েœ বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে বেশ কিছু করণীয় দিকগুলো তুলে ধরা হলো:

১. ঈষাণ কোনে (উত্তর-পশ্চিম কোনে) মেঘ জমলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাতের সময় ঘরের মধ্যে অবস্থান করতে হবে।
২. গভীর ও উলম্ব মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে বের না হওয়া; অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়া।
৩.  বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা বা মাঠ অথবা উঁচু স্থানে না থাকা।
৪. বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেতে বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়া।
৫. বজ্রপাতের আশঙ্কা হলে যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া।
৬. বজ্রপাতের সম্ভবনা দেখা দিলে টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা।
৭. বজ্রপাতের সময় লোহার শিক এবং মোবাইল টাওয়ার থেকে দুরে থাকা ।
৮. উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার, ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দুরে থাকা।
৯. গভীর ও উলম্ব মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকা।
১০. বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ না রাখা, সম্ভব হলে কোন কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া।
১১. বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সুইচ বন্ধ রাখা এবং বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ বিচ্ছিন্ন করা।
১২. বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আক্রান্তদের দ্রুত চিকিৎসা করা, প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকা বা হাসপাতালে নেওয়া।
১৩. বজ্রপাতে আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া।

বজ্রপাতে নিজে সতর্ক থাকা এবং অন্যকেও সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেওয়া উচিত। বজ্রপাতের করণীয় দিকগুলো মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিলে মানুষসহ সকল প্রাণহানি কমে যাবে। দীর্ঘস্থায়ী হিসেবে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রচুর পরিমাণে তাল, খেঁজুর এবং দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে বড় বড় গাছসহ তাল এবং খেঁজুর গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে।

happy wheels 2

Comments