একজন বনশাই শিল্পীর সবটুকু জুড়ে থাকে বৃক্ষ
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
“বৃক্ষের মৃত্যু বা ক্ষয় আমাকে কষ্ট দেয়। আমি যখন ক্লান্তি বোধ করি তখন দু-এক ঘন্টা বৃক্ষের মধ্যে কাটালে, বনশাইয়ের পরিচর্যা করলে সজীবতা ফিরে পাই। আমরা অনেকেই পাতার রঙটাই দেখি। বৃক্ষের কান্ডের রঙের মাঝেও লুকিয়ে থাকে অপার মুগ্ধতা। গভীর দৃষ্টিতে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। মুগ্ধ হতেই হবে।”
১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি বড় গাছকে শৈল্পিক ক্ষুদ্র রূপ দিয়ে বা ক্ষুদ্র সংস্করণ করে বনশাই তৈরি করে আসা বায়েজীদ বোস্তামী (৪৯) উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। তিনি পাবনার চাটমোহর উপজেলার ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের পাচুরিয়া গ্রামের আলহাজ মো. আনোয়ার হোসেনের ছেলে। কর্মরত আছেন চাটমোহর মহিলা টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজে, ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে। ডুমুর, পাকুর, বট, তেঁতুল, মহুয়া, জারুল, রেটুসা (চায়না বট), কেসিয়া, কাঞ্চন, বওলা, শ্যাওরা, জবা, ব্রায়া, গ্যাবেলিয়া, গুন্যা, শ্বেতচন্দন, ছাতিম, ফাইকাস, অপরাজিতা, মেহেদী, কামিনী, কৃষ্ণচূড়া, কদবেল, বোটলব্রাশ, বকুল, আঙুরসহ শতাধিক ফলজ, বনজ, গুল্ম, ভেষজ ও ফুলের গাছের দৃষ্টিনন্দন বনশাই এর এক মায়াময় জগত রয়েছে তার।
বায়েজীদ বোস্তামী বলেন, “১৯৯১ সালে ছাত্র থাকাবস্থায় শখের বশে বনশাই তৈরির কাজ শুরু করি। সেই থেকে ২৭ বছর যাবত করে আসছি। চাটমোহর ও পাবনার বিভিন্ন মেলায় আমার বনশাই গুলোকে প্রদর্শনীতে নিয়ে যাই। সহসা বিক্রি করি না। বনশাই কিনতে আসা মানুষটির আগ্রহ যাচাই করি। যদি তাকে বৃক্ষপ্রেমী মনে হয় তবে তার কাছে বিক্রি করি। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল এ ২৩ বছর চর্চার মাধ্যমে একশ বছর লুকের অবয়ব তৈরি করা একটি বটের বনশাই ৭৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি”।
একটি পাকুর গাছ দেখিয়ে তিনি আরো বলেন, “পাঁচ ছয় বছর পূর্বে পাবনা সদরের খেয়াঘাট এলাকা হয়ে হেটে যাবার সময় রাস্তার উপর পাকুর গাছটি পরে থাকতে দেখি। যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হচ্ছিল পরে থাকা পাকুর গাছটি। জানতে পারি পরিচ্ছনতা কর্মীরা রাস্তায় পাকুর গাছটি ফেলে গেছেন। সেখান থেকে গাছটি সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে এসে পরিচর্যা করি। দিনে দিনে শৈল্পিক রূপ দিচ্ছে। আজ তার শিল্প রূপ সবাইকে মোহিত করে।” এগারো বছর বয়সী অপর একটি পাকুর বনশাই দেখিয়ে তিনি বলেন, “চাটমোহর-পাবনা সড়কের পাশের মূলগ্রাম এলাকার আব্দুল জলিলের দোকানের উপরের চালায় পাকুর গাছটি বেড়ে উঠছিল। বার বার তিনি উপর থেকে গাছটি কেটে ফেললেও চালার উপর আবার নতুন শাখা প্রশাখা নিয়ে বেড়ে ওঠে গাছটি। কিছুদিন পরে বিরক্ত হয়ে তিনি গাছটি শিকড়সহ উপরে ফেলেন। আমি এটি নিয়ে এসে সুস্থ্ করি এবং আদরনীয় শিল্প বনশাইয়ে পরিণত করি। গাছটি অনেক শাখা মূল বিস্তার করেছে। গাছটির কান্ড বেশ প্রশস্ত হয়েছে।”
বনশাই চর্চাকারী বায়েজীদ বোস্তামী ১৯৯৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ত্রিশ শতাংশ জমির মাঝে নির্মিত বাড়ির সামনের অংশ বনসাইয়ে ভরা। অবসর সময়ে তার স্ত্রী ও পরিচর্যা করেন বনশাইয়ের। দুই ছেলে এক মেয়ে রয়েছে তার। বড় মেয়ে রুকাইয়া ক্যান্ডিডা সন্ধি এডওয়ার্ড কলেজে প্রাণীবিদ্যা বিষয়ে পড়ছে। ছেলে এইচ.এস. সি. পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু। আরেক সন্তান ছোট। বাইরে থেকে গ্রামে কেউ বেড়াতে এলে অন্তত একবার ঘুরে যান বায়েজীদের পাচুরিয়ার বনশাই জগতে। বছরের বারোমাস তার কোন না কোন ডুমুরের বনসাইয়ে ডুমুর ধরে থাকে। কয়েকটি ডুমুরের বনসাই মেটায় তার বাড়ির সবজির চাহিদার কিছুটা। ছুয়ে দিলে তেতুলের পাতা গুলো লজ্জাবতী পাতার মতো চুপসে বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান তিনি।
এছাড়াও ৪০টি খেঁজুর গাছ, ১৬টি তেতুল গাছ, জামসহ অন্যান্য বেশ কিছু গাছ রয়েছে তার বাড়িতে। রয়েছে একটি গরুর খামার। রয়েছে মাছ চাষের পুকুর।
“যে গাছগুলো আপনি বনসাইয়ে পরিণত করছেন সেগুলিকে প্রাকৃতিক ভাবে বাড়তে দিলে তা আরো পরিবেশবান্ধব হতো। সে ক্ষেত্রে আপনি কি গাছের, পরিবেশের অন্তরায় ঘটাচ্ছেন না? এমন বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার বনশাইয়ের অধিকাংশই পরিত্যক্ত গাছ। একজন বনসাই শিল্পী প্রচন্ড রকমের বৃক্ষপ্রেমী হয়ে থাকেন। নইলে তিনি বনসাই করতে পারবেন না। হৃদয়, মন, মনন অর্থাৎ তার সবটুকু জুড়ে থাকে বৃক্ষ। প্রকৃতিতে বেড়ে উঠছে এমন গাছ তুলে এনে বনসাই করি খুব কম। বৃক্ষকে করি দৃষ্টিনন্দন। করি মানুষের কাছে জনপ্রিয়।”
চীনা শব্দ পেনজাই থেকে জাপানী বনশাই শব্দের উৎপত্তি। বনশাই তৈরি করতে যে ট্রে বা পাত্র ব্যবহার করা হয় তাকে সাধারণভাবে বন বলা হয়। ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পাথর কেটে ট্রে তৈরি করে তাতে গাছ লাগানোর সন্ধান পাওয়া যায়। ২৬৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৪২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যকার লেখা লেখিতে পেনজাই শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। সময় ভেদে চিন-জাপান কোরিয়া ভিয়েতনাম থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বনশাই চর্চা বিস্তৃত হয়। ঘরবাড়ি সাজাতে সৈন্দর্যপ্রিয় অনেককেই বনশাই ব্যবহার করতে দেখা যায়।