পছন্দের জাত খুঁজে পেলেন নেত্রকোনার কৃষকরা
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং, সুমন তালুকদার
বারসিক’র উদ্যোগে গতকাল ১৫ নভেম্বরর ২০২১ জাতীয় কৃষি দিবস ও নবান্ন উৎসব উপলক্ষে বারসিক’র নেত্রকোনা কর্মএলাকায় কৃষক নেতৃত্বে আমন মৌসুমের ধানের জাত গবেষণা কার্যক্রমের এক কৃষক মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইউপি সদস্য মাহাবুব আলম পাঠানের সভাপতিত্বে মাঠ দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আটপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আশিকুর রহমান, উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মোঃ মনোয়ার হোসেন। এছাড়া নেত্রকোনা জেলার চারটি উপজেলা (আটপাড়া, কলমাকান্দা, নেত্রকোনা সদর ও কেন্দুয়া) এবং ময়মনসিংহ জেলার (তারাকান্দা) ৫১ জন কৃষক-কৃষাণী অংশগ্রহণ করেন। কৃষক মাঠ দিবসটি দু’টি ভাগে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমভাগে কৃষকরা সরেজমিনে গবেষণাধীন ও সংরক্ষণাধীন ধানের ৩৩০ টি প্লট পরিদর্শন করেন এবং এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচন করেন এবং দ্বিতীয় ভাগে কৃষকরা তাদের অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কৃষক মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারীদেরকে স্বাগত জানান বারসিক নেত্রকোনার অঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক শংকর ¤্রং মাঠ দিবস সম্পর্কে ব্রিফিং শেষে অংশগ্রহণকারী ও অতিথিদের সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন নিয়ে যান। অংশগ্রহণকারীরা মাঠ পরিদর্শন করে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে (আগাম, হেলে পড়েনা, গাছ মাঝারি, শীষ লম্বা, দানা বেশি, রং ভালো, ধানে মাঝারি/চিকন, সুগন্ধি, রোগ-বালাই সহনশীল ইত্যাদি) ১৩টি ধানের জাত এলাকা উপযোগি হিসেবে নির্বাচন করেন এবং আগামী মৌসুমে চাষের জন্য বীজের চাহিদা দেন।
মাঠ দিবস আলোচনায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নূর মোহাম্মদ বারসিক’র সহযোগিতায় এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনে কৃষকদের পরিচালিত প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রমের এবং বারসিক এর উদ্যোগে প্রায় তিনশতাধিক স্থানীয় ও কৃষক নেতৃত্বে ধানের জাত উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘ধানের জাত গবেষণা কার্যক্রম মূলত সরকারের কৃষি বিভাগের করার কথা, কিন্তু এ কাজটি করছে বারসিক। বারসিক’র প্রচেষ্টায় কৃষকরা তাদের পছন্দের ধানের জাত নিয়ে চাষ করতে পারছেন। এতে এলাকায় ধানের জাতবৈচিত্র্য যেমন বাড়ছে তেমনি মানুষ বৈচিত্র্যময় ধানের ভাত খেতে পারছেন।’ তিনি কালো চালের ধান (তাদিয়ান কালো, MDZ-52, JUNE-T)) জাতগুলো সম্পর্কে বলেন, ‘কালো/লাল রং এর চালগুলো খুবই পুষ্টিমানসমৃদ্ধ এবং দামেও অনেক বেশি। তাই এ জাতগুলো কয়েকজন কৃষকদের দিয়ে ফলন দেখার জন্য আলাদা করে নির্দিষ্ট জমিতে প্লট করে চাষ করানোর পরামর্শ দেন। এছাড়াও তিনি বীজ সংরক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করে সকল অংশগ্রহণকারী কৃষকদেরকে নিজেদের চাষকৃত ধানসহ সকল শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষণের পরামর্শ দেন।
সরেজমিনে গবেষণা প্লট ও সংরক্ষণ প্লটসমূহ পরিদর্শন করে ধানের জাত নির্বাচন শেষে বারসিক রামেশ্বরপুর রির্সোস সেন্টারের প্রশিক্ষণ কক্ষে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে এক আলোচনা সভা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কৃষক মাঠ দিবসের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গিয়ে তারাকান্দা উপজেলার কৃষক আব্দুল হামিদ বলেন, ‘বারসিক অফিসে অনেকগুলো ধান নিয়ে গবেষণা এবং জাত সংরক্ষণ কার্যক্রম দেখে আমি অভিভূত। আমি বিভিন্ন এলাকা থেকে নতুন নতুন জাতের ধান এনে জমিতে চাষ করি। এখানে এসে আমি ৮টি ধানের জাত নির্বাচন করেছি, যেগুলো আমি আগামী বছর নিজের জমিতে চাষ করতে চাই। এ আমন মৌসুমেও আমি ৭ জাতের ধান চাষ করেছি।’ কলমাকান্দা উপজেলার কৃষক আব্দুল মোতালিব বলেন, ‘আমি এ আমন মৌসুমে ২০টি ধানের জাত নিয়ে জাত নির্বাচনের জন্য কৃষকদের নিয়ে গবেষণা করছি। এখানে এসে আমি লালজিরা ও রহমত দু’টি জাত পছন্দ করেছি, যেগুলো আমি আগামীতে চাষ করব।’ নির্বাচিত ধানের জাতগুলো হল- সোনালি পাইজাম, রহমত, DS-09,, স্বর্ণা, লালজিরা, খেকশিয়াল, কাবুন্দুলান, তাদিয়ান কালো, কালোজিরা, সুবাস, বোরোঝাকি, স্বর্ণলতা, বাঁশফুল ও আব্দুল হেকিম।
বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান অতিথি ও কৃষকদের সাথে ‘জাতীয় কৃষি দিবস ও নবান্ন উৎসব’ এর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং সকল মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনে অবদানের জন্য কৃষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘আপনারা কৃষকরা নিজের পরিবারের জন্য খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি দেশের সকল মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করছেন। যার জন্য আমরা আজ বাজারে খাবার কিনতে পারছি। বারসিক আপনাদেরকে বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদনে সামান্য সহযোগিতা দিয়ে আসছে মাত্র।’
মাঠ দিবসের আলোচনা শেষে অনুষ্ঠানের সভাপতি স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের মেম্বার মাহাবুব আলম পাঠান নেত্রকোনা অঞ্চলে বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদনে বারসিক’র এলাকার কৃষকদেরকে ধান, সবজি ও শস্য ফসলের বীজ প্রদান, কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনসহ বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতার প্রশংসা করেন এবং নিজে ধীর্ঘদিন ধরে বারসিক’র সাথে বিভিন্ন ধরণের গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত থাকার কথা বলেন।