খলসুনী তৈরি ও বিক্রি করে চলে ওদের সংসার
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
বর্ষায় চলনবিল অঞ্চলের প্রতিটি জনপদ রূপ ধারণ করে ষোড়শী যৌবনার। খাল-বিল ভরে যায় পানিতে। বিলের সবুজ ধানক্ষেত যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। ক্ষেতে কাজ নেই, তাতে কী? জীবনযুদ্ধে খেটে খাওয়া মানুষগুলো হারতে নারাজ। জীবন-জীবিকার জন্য অভাবী মানুষেরা এ সময় বেছে নেয় অন্য পেশা। মাছ ধরার কাজে সম্পৃক্ত হয় তারা। তাই ব্যস্ততা বেড়ে যায় খলসুনী মতান্তরে চাঁই তৈরির কারিগরদের। সারাবছর চাঁই তৈরির কাজ কম বেশি করলেও জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে চাঁইয়ের কদর বেশি বাড়তে থাকে। বাঁশ, তালের আঁশ আর লই দিয়ে তৈরি মাছ ধরার যন্ত্র খলসুনী বা চাঁই তৈরি করে এখন স্বাচ্ছন্দে জীবন কাটাচ্ছেন চলনবিল এলাকার চাটমোহর, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, তাড়াশ, সিংড়াসহ এর আশপাশ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। আর এ যন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ ধরে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছেন হাজার হাজার জেলে।
চলনবিল এলাকায় প্রথম কবে ও কোথায় খলসুনি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, তাদের দাদার আমল থেকেই তারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত। অনেকে নতুন করে আসছে এ পেশায়। অনেকে জানান, বংশানুক্রমে তারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত।
বড়াইগ্রামের সাতৈল গ্রামের ছবের আলী প্রাং এর ছেলে আবুশামা প্রাং বলেন, “প্রথমে বাঁশ চিরে খিল তোলা হয়। সেগুলো শুকিয়ে নেয়া হয় হালকা রোদে। পচানো তালের ডাগুরের আঁশ দিয়ে খিল বান দেয়া হয়। এসব কাজে গৃহবধূ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরাও পরিবারকে সহায়তা করে থাকে। চলন বিলাঞ্চলের ধারাবারিষা, উদবাড়িয়া, সিথুলী, তালবাড়িয়া, সিরামপুর, দারিকুশি, সোনাবাজুসহ বিভিন্ন গ্রামে এখন দিনরাত চলে খলসুনী তৈরির কাজ।” তিনি আরো বলেন, “গত ২০ বছর যাবত আমি এ পেশায় সম্পৃক্ত। আমি বাঁশ চীরে শলাকা তৈরি করে দেওয়ার পর আমার স্ত্রী রেখা খাতুন তালের আশ দিয়ে শলাকাগুলো বান (বেঁধে ফেলা) দেন। এরপর আবুশামা বাঁধা ছাটার কাজ করে সেগুলো হাটি বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাই।” স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে সপ্তাহে ১০টি খলশুনী তৈরি করতে পারেন। এতে ২শ’ টাকার একটি বাঁশ, ২শ টাকার তালের আশ এবং ২০ টাকার লাইলন সূতা প্রয়োজন হয়। ১০টি খলশুনী গড়ে ৩ হাজার টাকা বিক্রি করেন। খরচ বাদে দুই হাজার ৫শ’ ৮০ টাকার মত থাকে তার। দুই জনের সাত দিনে ১৪ শ্রমিকের দাম পরে গড়ে ২শ’ টাকারও কম। বাড়িতে বসে মাসে ১০ হাজার টাকার মতো আয় করেন যা দিয়ে চলে তাদের সংসার। অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয় না এটাই তাদের শান্তনা।
দাড়িকুশী গ্রামের শাজাহান ফকির বলেন, “আমরা স্বামী স্ত্রী, আমার এক বোন ও আমার ছেলে বাড়ির এ চজারজন খলশুনী তৈরি করি। সপ্তাহে বিশটির মতো খলশুনী তৈরি করতে পারি। এতে ৯শ’ টাকার মতো খরচ হয়। ২০টি খলশুনী ৫ হাজার টাকার মতো বিক্রি করা যায়। চারজন কাজ করে সপ্তাহে চার হাজার টাকার মতো লাভ থাকে। এতে আমাদের সংসার চলে যায়।”
খলসুনীর পাইকারী ব্যবসায়ী চাটমোহরের রেলবাজার এলাকার আব্দুল মমিন, ক্ষতবাড়ি গ্রামের তয়জাল মোল্লার ছেলে শাহালম পাশর্^বর্তী উপজেলা গুরুদাসপুরের ধারাবারিষার বাবলুসহ অন্যরা জানান, চাটমোহরের অমৃতকুন্ডা চলনবিলের বড় খলসুনীর হাট। এ ছাড়া তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ হাট,গুল্টা হাট, রায়গঞ্জের নিমগাছীর হাট, সলঙ্গা হাট, চাটমোহরের ছাইকোলা হাট, মির্জাপুর হাট, নাটোরের গুরুদাশপুর হাট, চাচকৈড় হাটসহ অন্যান্য হাটে ও খলশুনী পাইকারি ও খুচরা ক্রয়-বিক্রয় হয়। পাবনা নাটোর সিরাজগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে পাইকাররা এ হাটে এসে খলশুনী কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন। আকার ভেদে খলশুনীর দামে রয়েছে অনেক তারতম্য। ৪শ’ থেকে ২ হাজার টাকা জোড়া পর্যন্ত বিক্রি হয় খলশুনী। প্রতি জোড়ায় তাদের একশ’ টাকার মতো লাভ থাকে। এ দিয়ে চলে তাদের সংসার।
এভাবে বাঁশনির্ভর এ শিল্পে সম্পৃক্ত হয়ে উৎপাদনকারী, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা, ব্যবহারকারীরাসহ সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। ছোট মাছের চাহিদার একটা বিরাট অংশ মেটাচ্ছে এ শিল্প।