বাঁশ কঞ্চির কাজ করে স্বাবলম্বী তিনশ’ পরিবার
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
“আমরা সবাই একটু ভালোভাবে চলতে সবাই চাই। যখন একটু অবসর পাই তখনই বাঁশের কাজ করি। সামান্য জমা জমি। সব সময় কাজ থাকে না। অন্যের বাড়ি কাজ করার চেয়ে নিজের আঙিনায় স্বাধীনভাবে কাজ করি। ডালি তৈরি করি। চাটমোহরের মির্জাপুর, রেল বাজার, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করি। এখন কঞ্চি পাওয়া যায় না বাপু। কঞ্চির জন্যি হরিপুর, বোয়াইলমারী, টলটলী পাড়া, চড়ই কোল, শিয়াল, চিরইলসহ দূর দূরান্তের বিভিন্ন গ্রামে যেতে হয়। বয়স হয়্যা গেছে এখন দূর দূরান্তে যাতি কষ্ট হয়।” কখনো সাধূ আবার কখনো চলতি ভাষায় এভাবেই নিজের অভিব্যক্তির কথা ব্যক্ত করেন পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার নূরনগর গ্রামের ষাটোর্ধ বাঁশ কঞ্চির কারিগর হযরত আলী। বাঁশ কঞ্চির সাথে ৩০ বছর যাবত অষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হযরত আলী বলেন, “এক একটা কঞ্চির দাম ৪ থেকে ৫ টাকা। একশ টাকা দামের একটা ডালি তৈরি করতে পাঁচ/ছয়টি কঞ্চির দরকার হয়। বাঁশের একটি চাক লাগাতে হয় ডালির উপরি ভাগে। সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা খরচ হয়। বিক্রি করতে পারি ৯০ থেকে ১শ’ টাকায়। এক জন মানুষ এক দিনে ৬/৭ টি ডালি বানাতে পারে। দিনে ৩শ’ থেকে সাড়ে তিন’শ টাকা লাভ থাকে।”
“আগে নাটক করতাম। বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের আয়োজনে যৌতুক ও ইভটিজিং বিরোধী অনেক নাটকের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জনসচেতনতা মূলক অনেক নাটকে অভিনয় করেছি ভাঙ্গুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দুই বছর আগে বাবা মারা যায়। নিজে ও অসুস্থ। স্ত্রী, তিন ছেলে মেয়ে মাসহ ৬ জনের পরিবারের ভরণ পোষণ করতে হয়। ১১ শতক বসতবাড়ি ছাড়া অন্য কোন জমা জমি নেই। মাঠের কাজ ও করতে পারি না। তাই একরকম বাধ্য হয়ে জীবন ও জীবিকার জন্য এখন পেশা হিসেবে বাঁশ কঞ্চির কাজকেই বেছে নিয়েছি। বাড়িতে বসে কাজ করা যায়।” পাশের ছোট মুদী দোকান দেখিয়ে বাঁশ কঞ্চির এ কারিগর নূরনগর গ্রামের আব্দুল মজিদ আরও বলেন, “একটি ছোট দোকান করেছি। কাস্টমার এলে সদাই দেই। অন্য সময় কাজ করি। পাইকারী ৭৫ টাকা এবং খুচরা নব্বই থেকে একশ টাকা বিক্রি করি প্রতি পিস ডালি। ডালির আকার ও আকৃতি ভেদে দামের ও তারতম্য আছে।”
স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন নূরনগর গ্রামের সবেদ আলীর ছেলে আল আমীন (২০)। আল আমীন বলেন, “পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থা থেকে বাঁশ কঞ্চির কাজ করে আসছেন। বাবা ও মায়ের বয়স হয়েছে। তারা অনেকবছর বাঁশ কঞ্চির কাজ করেছেন। এগুলো করেই আমাদের খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে। বড় ভাইয়েরা পৃথক হয়ে গেলে সংসারের হাল ধরতে হয় আমাকেই। তাই আর লেখাপড়া করা হয়নি। তিন শতক বসত বাড়ি ছাড়া চাষাবাদের জমি নেই। খাওয়া পড়া ঔষুধপত্র সাধ্যমতো সব কিছুর যোগান দেই বাঁশ কঞ্চির কাজ করে।” তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন রকমের ডালি, পলো, কুলো, চালুন, শর্পেশ, মাছের ঝাঁকা তৈরি করে হাট বাজারে বিক্রি করি।” বাড়ির সামনে রাস্তায় সোলার প্যানেল স্থাপিত হওয়ায় আলোর সমস্যা না থাকায় সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে পারেন। তিনি একা নন এলাকার অনেকে এখানে এসে একসাথে গল্প গুজব করেন এবং বাঁশ কঞ্চির কাজ করেন। তিনি আরো জানান, মাত্র ৫/৬ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে বাঁশের কাজ করে অনেকেই স্বচ্ছল জীবনযাপন করছেন। যারা একবারেই পুঁজি সংকটে থাকেন এমন ব্যক্তিরাও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে এ কাজ করে আসছেন।
একই গ্রামের মনিরুল ইসলাম (৩৩) বলেন, “জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর থেকেই কঞ্চির কাজ করে আসছি। নিজের ৫ বিঘা জমি আছে। কামলা নিয়ে জমি আবাদ করি।” স্ত্রী, তিন ছেলে মেয়ে ও মাকে নিয়ে ছয় জনের পরিবারের ভরণ পোষণ করতে হয় তাকে। বড় ছেলে আশরাফুল দহপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে, মেজ মেয়ে মনিকা এবং ছোট মেয়ে মেঘলা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে আসছে। তিনি জানান, কঞ্চিগুলো চেড়াই করে পাতলা করে হালকা রোদে শুকিয়ে কাজের উপযোগি করে নিতে হয়।
ষোল বছর যাবত বাঁশ কঞ্চির কাজ করে আসছেন নূর নগর গ্রামের লুৎফর রহমার (২৮)। বাবা, মা, স্ত্রী ছোট বোন ও দুই ছেলেসহ সাতজনের পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে তাকে। তিনি জানান, এ গ্রামে প্রায় সাড়ে ৪শ’ পরিবারের বসবাস। তার মধ্যে প্রায় তিনশত পরিবার বাঁশ কঞ্চির কাজের সাথে জড়িত। অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থরা ও জমাজমি চাষের পাশাপাশি বাঁশ কঞ্চি দিয়ে বিভিন্ন প্রকার গৃহস্থালী দ্রব্যাদি তৈরি ও বিক্রি করে থাকেন। ফরু, হজো, কালু, জলিল, জয়নাল, রাজা, বাদশা, সানু, ময়েজ, আয়েন, মাসুদ, সালাম, দবির, সুলতান ইব্রাহিমসহ এ গ্রামের প্রায় তিনশ’ পরিবারের কেউ না কেউ এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত। অনেক পরিবারের সবাই বাঁশ কঞ্চির হস্তশিল্প দ্রব্য তৈরি ও বিক্রি করেন।
নূর নগর গ্রামের বাঁশ কঞ্চির কারিগরেররা জানান, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের বাঁশের প্রয়োজন হলেও এ এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তেমন বাঁশ চাষ হয় না। মানুষ অন্যান্য ফসলাদির আবাদ করলেও বাঁশের আবাদে উৎসাহি হচ্ছে না। এক একটি বাঁশ ১শ’ ৫০ টাকা থেকে ২শ’ টাকায় বিক্রি হয়। পুরুষের পাশাপাশি বাড়ির বৌঝিরা বছরের প্রায় সব সময়ই এ কাজগুলো করে থাকেন। তবে বর্ষাকালে তাদের উৎপাদিত বাঁশজাত সামগ্রী কম বিক্রি হয়। এসময় দামও কম পাওয়া যায়। এ কাজ করে চলে তাদের সংসার। কারো কাছে হাত পাততে হয় না।
বর্তমানে কঞ্চি সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় কঞ্চি কিনতে তাদের পাবনার শানিকদিয়ার, আতাইকুলা, আটঘরিয়া, বুধপাড়া, নেংড়ি, মাস্তানবাজার, শিবপুর, ফৈলজানাসহ বিভিন্ন এলাকায় যেতে হচ্ছে। বয়স্ক মানুষদের দূর দূরান্তে গিয়ে কঞ্চি সংগ্রহ এবং তৈরিকৃত সামগ্রী হাট বাজারে বিক্রি করতে কষ্ট হলেও স্বাধীন পেশা হিসেবে এটিকেই তাঁদের জীবন ও জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন।