বাঁশ শিল্পে বদলে যাওয়া দু’শতাধিক পরিবারের সাফল্য গাঁথার গল্প
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ থেকে
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামের রাজবংশী পাড়া। প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের বাস এখানে। কয়েক বছর আগেও দারিদ্রতা ছিল এই পরিবারগুলোর নিত্যসঙ্গী। অভাব-অনটনের অক্টোপাসে জড়িয়ে থাকা পরিবারগুলোর দিন কাটতো খুবই কষ্টে। অর্থাভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল তাদের সন্তানেরা। যাদের ছিল না কোন কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক চাহিদার সর্বোত্তম সুবিধা। দীর্ঘদিন ধরেই এ গ্রামের নারী পুরুষ অজ্ঞতা-অশিক্ষার কারণে ভালো কাজের সুযোগ পায়নি। অথচ বাঁশ শিল্পের ছোঁয়া পেয়ে ক্রমেই আত্মনির্ভরশীল হয়ে পরছে এ গাঁ’য়ের মানুষ। বর্তমানে রাজবংশী পাড়া রীতিমতো অর্থনৈতিক মডেলে পরিণত হয়েছে। গ্রামের নারীরা এখন আর “ঘরের কোণে বন্দী জীবন” নীতিতে বিশ্বাসী নয়, তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। গ্রামীণ এ শিল্পের আওতায় এসে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও এখন হয়ে উঠেছে আত্মনির্ভরশীল। তারা খুঁজে নিয়েছে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচার মাধ্যম।
বাঁশের তৈরি নানান তৈজসপত্র বিশেষ করে “বাঁশের বাণা” (বেড়া জাতীয়) ভাগ্য বদলে দিয়েছে বানিয়াজুরী ইউনিয়নের জাবরা গ্রামের মানুষের। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গ্রামের কর্মক্ষম মানুষের ব্যস্ত সময় কাটে বাঁশের বিভিন্ন ব্যবহার্য্য সামগ্রী তৈরিতে। এ কাজের মাধ্যমে নি¤œ আয়ের প্রায় দুই শতাধিক পরিবার এখন স্বাবলম্বী। বাঁশের তৈরি বাণা শিল্প এদের ভাগ্য বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে দিয়েছে পুরো গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্র।
আশির দশকের শেষের দিকে ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের জাবরা গ্রামের হাতে গোনা দু-তিনটি পরিবার বাঁশ শিল্পের কাজ শুরু করেন। অল্পদিনেই সফল হন তারা। তাদের দেখাদেখি গ্রামের অনেকেই জড়িয়ে পড়েন এ শিল্পের সঙ্গে। বর্তমানে গ্রামজুড়েই এ শিল্পের ব্যাপ্তি। আর এ শিল্পের প্রসার ও পরিচিতি দেশের অনেকটা সীমানা জুড়েই বিদ্যমান।
এখানকার তৈরি বাঁশের বাণা দেশের ঢাকা, গাজিপুর, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ, পাবনা, সাতক্ষিরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা, নরসিংদীসহ প্রায় ১৭টি জেলায় পাইকারি বিক্রি করে থাকেন। সরেজমিন জাবরার রাজবংশী পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, পরিবারগুলোর সবাই বাঁশের বাণা তৈরিতে ব্যস্ত। এ কাজে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে নারীরাও কাজ করে যাচ্ছে। বাড়ির বউ-ঝিরা বসে না থেকে ঘর গৃহস্থলীর কাজ শেষে যোগ দেন পুরুষদের সঙ্গে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামটিতে উৎসবের আমেজে চলছে ওই কাজ।
জাবরা মাঝিপাড়া এলাকার বয়োবৃদ্ধ মাদারি রাজবংশি জানান, এই গ্রামে প্রায় তিন যুগ ধরে বাণা তৈরির কাজ হয়। লাভ যাই হোক না কেন তারা এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। সরকারি-বেসরকারিভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হলে তারা এ শিল্পকে আরো প্রসারিত করতে পারবেন বলে জানান। দেশের অনেক বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হবে। জাবরা বাজারের পাশেই কথা হয় রতন রাজবংশীর সাথে। তিনি বলেন, “এই শিল্পের সাথে ১৮০টি পরিবার সরাসরি জড়িত। পৈত্রিক পেশা হিসেবেই তারা ওই কাজ করে থাকে। এখানে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি এ কাজে মাস প্রতি গড়ে ৫/৭ হাজার টাকা উপার্জন করে। এতে তাদের পড়াশোনার খরচ ছাড়াও পরিবারের আর্থিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।”
বাণা শিল্পের কারিগড় গৃহবধূ আমেলা বেগম (৪০) বলেন, “বিয়ের পর থেকেই আমি বাণা তৈরি করছি। প্রতিদিন ঘরের কাজের পাশাপাশি দুটি বানা তৈরি করা যায়। তাতে গড়ে দিন প্রতি ৩শ/৪শ টাকার মতো মজুরি উপার্জন করতে পারি। বছরের বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত কাজের চাহিদা একটু বেশি থাকে। তখন উপার্জন একটু বাড়ে।”
পাইকারী বিক্রেতা উজ্জল কুমার রাজবংশী জানান, ৯ ফুট/১৫ ফুট আয়তনের একটি বাণা তৈরি করতে গড়ে ১১শ’ টাকার মতো খরচ হয়। বিক্রি হয় ১২ শ থেকে ১৩ শত টাকায়। পাইকাররা বাড়ি থেকে এগুলো কিনে নিয়ে যায়।
স্থানীয় বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়–য়া ছাত্রী পূর্ণিমা রাজবংশী ও ছাত্র মাসুম মিয়া জানান, তারা সংসারে অন্যান্য কাজ ও লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবা-মাকে সাহায্য করে। তাতে বাবা মায়ের অনেকটা কষ্ট দূর হয় এবং সেই সঙ্গে কিছু বাড়তি কিছু টাকা সঞ্চয় হয়। ভবিষৎ এর জন্য এই সঞ্চয় বাবা-মার অনেক উপকারে আসবে। শুধু তাই নয়, বাঁশের বাণা তৈরির টাকায় পড়াশোনা শেষ করা এখানকার কমপক্ষে ১০/১৫ জন ছেলে- মেয়ে সাফল্যের ছোঁয়া পেয়েছে। বর্তমানে চাকুরি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন পেশায় ভালো অবস্থানে রয়েছেন।
বানিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম চতু জানান, সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা ও সুদমুক্ত ঋণ পেলে এই এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ বাণা শিল্পের আরো ব্যাপক প্রসার ঘটবে। সেই সাথে এলাকার অনেক শিক্ষিত মানুষ ও বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।