সাম্প্রতিক পোস্ট

সৌখিন কৃষক আবুল মিয়া

নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রানী সিংহ
নিজেদের আশপাশে যা সম্পদ আছে তা ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে জীবিকা তৈরি করে বেঁচে থাকতে চায়। তেমনি মাটির সাথে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের কৃষি। উপযুক্ত পানি, মাটি, বাতাস পেলে যেমন জীবের জন্ম হয় তেমনি মাটি, পানি, বাতাস ভালো রাখার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জ্ঞানের, অভিজ্ঞতার ও সক্ষমতার। প্রকৃতিই ছিল মানুষের জ্ঞান আহরণের একমাত্র উৎস। প্রকৃতি পাঠ করে জীবনধারা সংস্কৃতি পরিচালিত হত।


আধুনিকতায় গতি এনেছে মানুষের জীবনে। কলকারখানা বেড়েছে, যন্ত্র বেড়েছে, শিল্প বেড়েছে, বেড়েছে কোম্পানি, বাড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশকে জানার ইচ্ছা, বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে চাহিদা। মানুষের এই চাহিদা পূরণে বাণিজ্যিকিকরণ চিন্তাধারা আমাদের ভেতরে প্রবেশ করেছে। যতই আমরা প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমাদের জ্ঞান অর্জনের উৎস ছোট হতে হতে নোটপেডে এসে পৌছেঁছে। এ থেকে বাদ যায়নি আমাদের কৃষিও।


তারপরও কিছু মানুষ আমাদের আশা যোগায় নিজের জ্ঞান, সম্পদকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতিকে ভালো রাখার এবং নিজেদের ভালো রাখার নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নেত্রকোনা জেলার চল্লিশা ইউনিয়েনের রাজেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক আবুল মিয়া (৬৩) তেমনই একজন মানুষ। তিনি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে তিনি ৩য় সন্তান। বাবার সাথে কৃষি কাজে সহায়তা করতে করতে হাতেখড়ি হয়। লেখাপড়ার তেমন চল না থাকায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পেরেছেন। একটু লেখাপড়া থাকার কারণে ১৯৮২ সালে সুযোগ পান রেল ষ্টেশনের লাইন ম্যান হিসাবে কাজ করার। বাড়ি থেকে কিছু দূরে গিয়ে কাজ করতে হত। প্রতিদিন বাড়ি থেকেই কাজে যেতেন।
কৃষির প্রতি আলাদা ভালোবাসা থাকার কারণে যে ফসলগুলোতে বেশি পরির্চযা করতে হত না তেমন ফসল চাষ করতেন। ২০ শতক জমিতে আলু, মাসকালাই, মরিচ, হলুদ, রসুন চাষ করতেন। তাছাড়া শীতকালে অল্প করে শাকসবজি করতেন। বিয়ে করেছেন পার্শ্ববতী গ্রামে। তাঁর স্ত্রী মমতা বেগমও একজন আর্দশ কৃষাণী। তিনি স্বামী কাজে যাওয়ার পর বাড়ির আশপাশসহ জমির ফসলের পরির্চযা করতেন। সংসার জীবনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করেন নিজের হাতে। কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেলে সেটিও যোগাড় করতেন গ্রাম থেকে। আজ পর্যন্ত হলুদ, মরিচ কিনে খাননি তাঁরা।


২০১৮ সালে আবুল মিয়া অবসর গ্রহণ করেন। অবসরে আসার পর বাড়িতে গরু কিনেছেন এবং নতুন করে কৃষির সাথে জীবন শুরু করেন। নিজের গ্রামের শাকসবজি চাষের প্রচলন থাকায় আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। প্রতিবেশি কৃষকদের সাথে সখ্যতা, সরকারি কৃষি অধিদপ্তরে চাকুরিজীবি আত্মীয়র পরার্মশ ও সহায়তায় ২০ শতক জমিতে বৈচিত্র্যময় শাকসবজি (লাল শাক, পালংশাক, ডাটা, পুইঁশাক, বেগুন, পেঁয়াজ, হলুদ, মরিচ, কলমিশাক) ও ৭০ শতক জমিতে ধান, পাট, সরিষা, গম চাষ শুরু করেন। তাঁর সবজি বাগানে এখন বারোমাসেই কোন কোন সবজি থাকে। নিজের ভালো লাগা থেকে গড়া সবজি বাগানকে আরো আর্কষণীয় করতে বাগানের কাঠামোগত পরিবর্তন আনেন। লতানো গাছের জন্য ফসল রক্ষার বেড়ার সাথে পাখার মত ছাউনি আর জমির ফসলের জন্য আলাদা আলাদা বেড তৈরি করেছেন। বাড়িতে বৈচিত্রময় ফলের গাছ রোপণ করে যাচ্ছেন। নিজের সবজি বাগানকে আরো আর্কষণীয় করে তুলতে বেড়াতে রং এবং গেইট করেছেন। তাছাড়া তিনি সবজি চাষে জৈবসার, গোবর, ছাই ব্যবহার করেন।
তাছাড়া তিনি গ্রামের কৃষক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করছেন। নিজে বীজ সংরক্ষণ করে চাষ এবং বিনিময় করেন। অন্য কৃষক-কৃষাণীদের বীজ সংরক্ষণের এবং পরিবেশবান্ধব চর্চার উৎসাহ দিয়ে থাকেন। অন্য কৃষকদের থেকে আলাদাভাবে বাগান করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার সখ লাগে জমিতে কাজ করতে। আমি যা কিছু করি সুন্দর করে করার চেষ্টা করি। অহন জমি মাটিই আমার বন্ধু। সংসারে যা কাজে লাগে সব কিছুই নিজে করার চেষ্টা করি। বাজার থেকে হঠ্যাৎই কিনতে হয়।”
বর্তমানে তাঁর বাড়ীতে হাসঁ, মুরগি, গরু, কেচোঁ কম্পোস্টসহ আম,কাঠালঁ,কামরাঙ্গা,পেয়ারা, মালটা, লেবু, আমলকি, সাজনা, সুপারি, পেপেঁ গাছ আছে।


তিনি ৪ সন্তানের জনক। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা করাচ্ছেন। বড় ছেলে ¯œাতক শেষ করে নেত্রকোনা জুিডশিয়াল মেজিষ্ট্রেট কোর্টে চাকুরি করছেন, এক মেয়েকে অর্নাস পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ২য় মেয়ে এইচ.এস.সি এবং ৩য় মেয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ছে।
সৌখিন কৃষক আবুল মিয়া নিজের অবসর সময়কে ভালোলাগায় পরিবর্তন করে স্থায়িত্বশীল জীবনযাপনের এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন, যা আমাদের প্রবীণদের অনুপ্রেরণা যোগাবে ।

happy wheels 2

Comments