কলমাকান্দার সংগঠিত কৃষি শ্রমিকদের কথা
নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন। এইসব সংগঠনগুলোর অধিকাংশেরই রয়েছে নিজস্ব লিখিত কাঠামো। আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত যখন দেখি এমন কতগুলো জনগোষ্ঠীকে যারা শুধুমাত্র জীবিকার তাগিদে একে অপরের উপর বিশ্বাস ও ভরসা করে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠিত তখন সেটা কিছুটা ব্যতিক্রম মনে হয়। এমনই একটি সংগঠিত কৃষি শ্রমিক রয়েছে কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের হাসেনাগাও গ্রামে। যারা প্রায় ৭ বছর ধরে নির্দিষ্ট (শুধুমাত্র ধান কাটার মৌসুমে) সময়ের জন্য তারা সংগঠিত।
১৫ জন সদস্যের কৃষি শ্রমিকরা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শুরু করেন প্রায় ২০১১ সাল থেকে। প্রতি আমন ও বোরো মৌসুমের ধান কাটার সময় হলেই তারা দলবদ্ধ হতে শুরু করেন এবং ধান কাটা শেষ হলেই পুনরায় যার যার মত বিভিন্ন কাজে চলে যান। শুরুতে ১০ জনকে নিয়ে পথচলা শুরু করেন দলনেতা শামসুদ্দিন (৪৫)। একজন দুজন করে যেসব কৃষি শ্রমিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধান কাটতেন তাদের সবাইকে একদিন একত্রিত করে দলনেতা তাদেরকে নিয়ে তার চিন্তার কথা সহভাগিতা করেন। এতে সবাই একমত পোষণ করেন এবং একসাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তাদের একসাথে মৌসুমভিত্তিক দলবদ্ধভাবে কাজ করা।
এ সম্পর্কে দলনেতা শামসুদ্দিন বলেন, “একজন একজন কইরা কাজ করলে সব সময় কাজ খুজার লাইগ্যা একদিন সময় নষ্ট করা লাগে। আবার কাজ পাইলেও কয়েকজন জোগার করা লাগে। জোগার করতে না পারলে কাজ হাতছাড়া হইয়া যায়। তাই আমি চিন্তা করছি আমাদের যদি দল থাকে তাইলে জমির মালিকরাই আমাগো খুজবো। এখন ধান কাটার মৌসুমে একদিনও আমাদের কাজ মিস যায়না। আমাদের মত দলে কাজ করলে শ্রমিকরাও কাজ পাইবো। আবার কৃষকরাও সময়মত ধান কাটাইতে পারবো।”
নামবিহীন সংঘবদ্ধ এই দলের সদস্যরা ধান কাটার সময় কমলা রঙের ইউনিফর্ম পড়েন। ইউনিফর্মটিই তাদেরকে অন্যান্য শ্রমিকদের তুলনাই ভিন্নতর করে তুলেছে । ইউনিফর্মটি তাদেরকে শুধু আলাদাভাবে পরিচিতির জন্যই নয় এর কিছু সুবিধাও রয়েছে। এ সম্পর্কে শ্রমিক মজিবুর রহমান (৪০) বলেন, “আমরা যখন ধান কাটার জন্য বের হই তখন এক এক জন এক এক সময়ে বের হয়। আবার সবাই মোবাইল নিয়াও বাইর হইনা। তাই কে কোন সময় কোন জায়গায় আছে তাও অনেক সময় বুঝা যায়না। কিন্তু এই পোষাকটা পইরা যখন রাস্তাই বাইর হই তখনই দূর থেইকাও বুঝা যায় উনি আমার দলের লোক। আর যখন হাওরের মাঝে ধান কাটতে যায় তখন অনেকে দলে দলে ধান কাটে। দূর থেইকা বুঝা যায় না কোনটা আমার দলের লোক। কিন্তু এই জামাটা থাকাতে অনেক বন্দের মাঝখানে অনেক জনে ধান কাটলেও এখন খুব সহজে খুইজা পাওয়া যায়। আর রাস্তার পাশে ধান কাটার সময় সবাই আমাদের দিকে এক নজর হইলেও তাকায়। অনেক ভালো লাগে।”
এই দলের সর্বকনিষ্ঠ যুবক শ্রমিক আশরাফুল (১৮) তাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ১২ বছর বয়স থেকে। পড়াশুনা করতে পারেনি পরিবারের আর্থিক দূরাবস্থার কারণে। সংসারের অভাব দূর করার জন্য কাজে নামতে হয়েছিল। আর কাজ করার জন্যও তেমন কাজ খুজে পাওয়া যাচ্ছিলনা। অবশেষে শ্রমিকদের এই দলে যুক্ত হয়ে কয়েকমাস আয় করার সুযোগ তৈরি হয়। এই দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা তিনি বলেন, “আমি যহন প্রথম কাজ করি তখন তাদের সাথে কুলাইয়া উঠতে পারতামনা। তারা আমারে অনেক সাহায্য করসে, আমাকে শিখাইয়াও দিসে। আমাদের দলে কারো সাথে কোন ঝগড়া হয়না। কয়েক মাসের লাইগ্যা একসাথে কাজ করলেও সব সময়ের জন্যই আমরা সবার খবর রাখি, সবার লাগিই মন টানে।
বর্তমানে শহরমূখী জীবন যাপনের ফলে এলাকায় ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক সংকট দেখা যায়। ফলে কৃষকগণ সঠিক সময়ে ধান কাটতে না পেরে প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে যান এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব কৃষি শ্রমিকেরা এককভাবে কাজ করার ফলে কাজ পেতে সমস্যা হয় তাদের জন্য হাসেনাগাও গ্রামের এই কৃষি শ্রমিক দলটি উদাহরণ হতে পারে।
ধান যেমন আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তেমনি শ্রমিক সমাজকে সংগঠিত হতেও সাহায্য করে। তার বাস্তব উদাহন হাসেনাগাও গ্রামের নামবিহীন সংগঠনটি। সমাজে যত ধরনের সামাজিক সংগঠন রয়েছে তার মধ্যে এটি ব্যতিক্রমী সংগঠনগুলোর একটি। এই সংগঠনের প্রেক্ষাপট, ব্যবস্থাপনা,সময়কাল অন্যান্য সংগঠনের থেকে ভিন্নতর।