অতিবৃষ্টি: বিপন্ন কৃষি, হতাশায় কৃষক
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, খরা, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি কারণে বেশিরভাগ সময় ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এই ক্ষতিগ্রস্ততার জন্য দূর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের কৃষকদের। তাঁদের জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন হলো কৃষি। আর সঠিক সময়ে যদি কৃষিজ ফসল উৎপাদন না করতে পারেন তবে তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শুধু তাই নয় মানসম্মত ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়, বাজার নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়, কৃষকগণ মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। এছাড়া সামাজিক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধিসহ অনেক কৃষকের পারিবারিক সম্পদ (যেমন হাঁস, মুরগি, গরু অনেক ক্ষেত্রে কৃষি জমি) বিনষ্ট হয়।
গত বোরো মৌসুমে ধান ফসল সংগ্রহ ও বিক্রি করতে গিয়ে অনেক কৃষক আর্থিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষককে কৃষি জমি বন্ধক দিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই চলমান সময়ের অতিবৃষ্টিতে আবারো তাঁরা আরেক দফা ক্ষতির সন্মূখিন হয়ে পড়ছেন।
বর্তমান সময়ে অতি বৃষ্টিতে নেত্রকোণা জেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নেত্রকোণা সদর উপজেলায় যদিও বাড়ি বা রাস্তাঘাট এখনো পানিতে ডুবে যায়নি। কিন্তু কৃষকের ফসলি জমিতে পানি থৈ থৈ করছে। যাদের বাড়ির আঙিনা একটু নিচু ধরণের, তাঁদের আঙিনাতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। এসমস্ত জায়গায় তাঁরা সব্জীর আবাদ করে নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রিও করতেন। কিন্তু জমে থাকা পানিতে নতুন করে সব্জী চাষ করা তো দূরের কথা, রোপণকৃত সব্জীগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে।
এখন সব্জীর ভরা মৌসুম। চালকুমড়া, ঢেঁড়স, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, পুঁইশাক, করলা, ডাটা, কাঁকরোল ইত্যাদি সব্জী প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় শোভা পেতো। কিন্তু গত কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে এসকল সব্জী গাছের গোড়ায় পানি জমেছে। যার কারণে গাছগুলো পচে গেছে এবং গাছে থাকা সব্জীর বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। ফসলে রোগবালাই দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোড়া পঁচে গিয়ে গাছগুলো মরে গেছে। ফলে এগুলোতে আর নতুন করে সব্জী ধরছেনা। যে কৃষকগণ পাকা মরিচ সংগ্রহ করার জন্য গাছগুলো জমিতে রেখে দিয়েছিলেন, সেই গাছেরও পাতা কুঁকড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থায় ফসল বিক্রি করা তো সম্ভবই না, কৃষকদের পরিবারের চাহিদাও পূরণ হবেনা। তাই সব্জীর জন্য একমাত্র বাজারের উপর তাঁদের নির্ভর করতে হবে।
এই এলাকায় অধিকাংশ কৃষক একটু বেশি দামের আশায় বিভিন্ন সব্জীর বীজ আগাম রোপণ করেন। এর জন্য তাঁরা আষাঢ় মাসকেই বেছে নেয়। অনেক কৃষক সেই মোতাবেক শিম, দেশি লাউ ইত্যাদির বীজ রোপণ করেছিলেন। কিন্তু অতি বৃষ্টির কারণে রোপণকৃত বীজের জায়গায় পানি জমে বীজ নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি কমে গেলে তাঁদেরকে আবারো বীজ রোপণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সব্জী উৎপাদনের সময় পিছিয়ে যাবে এবং তাঁরা সঠিক মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন না।
একটানা বৃষ্টির পরে যদিওবা দুপুরে রোদ উঠে আবার বিকেলে বৃষ্টি হয়। আবহাওয়ার এই অবস্থায় কৃষকগণ বীজ রোপণ করতে ভরসা পাচ্ছেন না। কারণ একবার বীজ নষ্ট হলে তাঁদেরকে পুনরায় বীজ রোপণ করতে হবে। এভাবে বারবার রোপণের ফলে তাঁদের সংরক্ষিত বীজের সংকট দেখা দিবে। তাছাড়া সঠিক সময়ে ফসল চাষ করতে না পারলে জমি পতিত থাকবে। অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং অল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় কৃষকগণ বাণিজ্যিক চাষাবাদের দিকে অগ্রসর হবে।
শুধু সব্জী চাষে অনিশ্চয়তা নয়, আগামী আমন মৌসুমের বীজতলা তৈরীতেও কৃষকরা সমস্যাগ্রস্ত। যে সমস্ত জমিতে তাঁরা বীজতলা তৈরী করেন, সেখানেও পানি জমে আছে। তাছাড়া আবাদি জমিগুলোতে এখন হালচাষ করার সময়। পানি থাকার কারণে তাঁরা সেটিও করতে পারছেন না। কৃষি শ্রমিকরাও কাজের অভাবে বেকার হয়ে বাড়িতে বসে দিন কাটাচ্ছেন। সব মিলিয়ে কৃষিব্যবস্থা এখন সংকটাপন্ন।
জমির মাটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকলেও ভালো ভাবে বীজের অঙ্কুরোদগম হয়না। তাই পানি সরে গিয়ে মাটি ভালোভাবে না শুকানো পর্যন্ত বীজতলা তৈরী বা সব্জীর বীজ রোপণ করা সম্ভব নয়। এই এলাকার কৃষকদের ভাষ্যমতে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হতে পারছেনা। যদি বহমান পানি নদী ধারণ করে নিয়ে যেতো তাহলে জমিতে থাকা পানি অতি দ্রুত সরে যেতো।
এখন শুধু অপেক্ষার পালা। কবে পানি সরে গিয়ে জমি আবার উর্বর হয়ে উঠবে। সবুজ ফসলের দোলা লাগবে কৃষকের আঙিনায়। কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে গ্রাম বাঙলার প্রতিটি মাঠ, ফসলি জমি।