কৃষিতে বাঁচা, কৃষিতে সফলতা
উপকূল থেকে বরষা গাইন
শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের খুটিকাটা গ্রামের কৃষাণী সন্ধ্যা রানী (৪৫)। ১৯ বছর বয়সে সুনীল চন্দ্র সরকারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন থেকে সংসারে খুব অভাব ছিল। তাঁর স্বামী দিনমজুরের কাজ করতেন। সংসারের অভাব থাকার কারণে স্বামীর পাশাপশি সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য কৃষিকাজ শুরু করেন তিনি। সংসারে আয়ের উৎস ও কর্মসংস্থান হিসেবে কৃষিকাজে আশার আলো দেখতে পান। সন্ধ্যা রানীর এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। সংসারে অভাবের তাড়নায় নিজেসহ ছেলে মেয়েদের সোনালী আ্যাঁশ পাটের তৈরি চট গায়ে দিয়ে শীত পার করেছেন। সংসারে অভাব অনেক রকমের থাকে তার মধ্যে খাবার ও পোশাকের অভাব ছিল চরম পর্যায়ের। অভাবের জন্য ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা পর্যন্ত করাতে পারেননি। অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি করে কোন রকমে সংসার চালিয়েছেন অসহায় বাবা-মা।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2024/03/IMG_20240312_132537-1024x477.jpg)
সন্ধ্যা রানী এবং তার স্বামী সুনীলচন্দ্র সরকার (৫৫) দুজন মিলে মাত্র ৫ কাঠা জমি বর্গা নিয়ে সেই জমিতে ২০০০ সাল থেকে কৃষিকাজ শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে উৎপাদিত সবজি দিয়ে তার পারিবারিক চাহিদা পূরণ করে বাড়তি সবজি তারা পাশের প্রতিবেশীকে বিক্রয় করতেন। পরে একটু একটু করে তারা চাষের জমি বাড়াতে থাকেন এবং বাড়তি সবজি বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেন। বর্তমানে তিনি কঠোর পরিশ্রম ও সবজি চাষ করে ৩.৫ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন এবং ৫.৫ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে কৃষি কাজ করছেন। সন্ধ্যা রানী, তার স্বামী এবং ছেলে নীলকমল সরকার (২৬) তিনজনের একমাত্র কর্মসংস্থান কৃষিকাজ। সন্ধ্যা রানী বলেন, “কৃষিতে আমাদের বেঁচে থাকা, কৃষিতে আমরা স্বপ্ন দেখি। আমরা কখনও বসে থাকি না, মাঠে হোক আর বাড়িতে হোক কিছু না কিছু করি।”
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2024/03/IMG_20240312_133202-1024x477.jpg)
সন্ধ্যা রানীর নিজস্ব একটা গরু ছিল যেটা তাকে তার দিদিমা দিয়েছিলেন। একটা গরুতে তার পরিবারের সারাবছরের জ¦ালানির অভাব পূরণ হত না। যে কারণে তাকে বিলে গরুর গোবর খুটতে হত। গোবর দিয়ে তিনি সারাবছরের জ¦ালানির জন্য মশাল, ঘুটে বানিয়ে বাড়তি গোবর ক্ষেতে ব্যবহার করতেন। বর্তমানে তার ৫টি গরু আছে। গত বছর তিনি ৩টি গরু ১০৫,০০০ টাকায় বিক্রয় করেন। এই টাকা দিয়ে তিনি সবজি চাষের জন্য ভিটা উঁচু করেন।
সন্ধ্যা রানী ২০০২ সাল থেকে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির যাত্রা শুরু করেন। একদিন বিলে গোবর খুটতে গিয়ে পাশবর্তী গ্রামের নারীদের থেকে তিনি ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো কম্পোস্ট সম্পর্কে ধারণা পান এবং একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সন্ধ্যা রানীকে প্রশিক্ষণসহ ২ টি নান্দা ও ২৫০ গ্রাম কেঁচো দেন। বর্তমানে তিনি প্রতিবছর বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার বিক্রি করার জন্য ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন। বাড়ির গোবর ব্যবহার করেও প্রতিবছর গ্রামের অন্যদের ১০/১২ গর্ত গোবর কিনে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করেন। নিজ জমিতে জৈব সার ব্যবহারের পাশাপাশি বাড়তি সার ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রয় করেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2024/03/IMG_20240312_125856-1024x477.jpg)
সঠিক যোগাযোগ এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যম না থাকার কারণে তিনি উৎপাদিত সবজি এবং জৈব সার ন্যায্যমূল্যে বাজারজাত করতে পারছেন না। তাদের এলাকায় যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটা মাটির। তিনি বলেন, “প্রতিদিন ভোরে মাথায় করে সবজি নিয়ে বাজারে যাই। প্রথম সকালে বাজারে যেতে পারলে সবজির ভালো দাম পাওয়া যায়, না হলে কম দামে সবজি পাইকারী দিয়ে আসতে হয়। তবে কৃষিকাজ করে আমরা ভালো আছি এবং সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে।”
সন্ধ্যা রানীর মত গ্রামের আরো অনেক উদ্যোগী নারী কৃষিকাজ করে সংসার নির্বাহ করছেন। তাদেরকে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগ্রহ ও সচেতনতা বাড়াতে পারলে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব কমানো যাবে।