সামষ্টিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে কৃষিজমি সুরক্ষার বিকল্প নেই

সামষ্টিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে কৃষিজমি সুরক্ষার বিকল্প নেই

সাতক্ষীরা থে‌কে গাজী মা‌হিদা মিজান,

কৃষিজমি অকৃষিখাতে চলে যাওয়ায় কৃষিনির্ভর অর্থনীতির সামষ্টিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন বসতভিটা, রাস্তাঘাট-অবকাঠামো নির্মাণ, ইটভাটা স্থাপন, কল-কারখানা ও নগরায়ণে প্রতিবছর এক শতাংশ কৃষি জমি নষ্ট হওয়ায় একদিকে যেমন আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন কৃষি আবহাওয়াকে দূষিত করার মাধ্যমে কৃষির উৎপাদন ব্যাহত করছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ভূমির অপব্যবহার রোধ ও কৃষিজমি সুরক্ষাকল্পে আইন প্রণয়ন ও এর কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে দেশের সামষ্টিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। প্রস্তাবিত কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১৫ দ্রুত পাশ করে এর বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার।


গতকাল সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ডিজিটাল কর্নারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক আয়োজিত ‘কৃষি জমির বর্তমান অবস্থা, সংকট, সংকটের কারণ এবং সমাধানের পথ’ শীর্ষক এক সেমিনার ও মতামত সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

সভায় সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী ফাতেমা তুজ জোহরার সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুমনা আইরিন ও সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মনির হোসেন। বারসিক কর্মকর্তা গাজী মাহিদা মিজানের সঞ্চালনায় সভায় মতামত পেশ করেন সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কোহিনুর ইসলাম, উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার সহিদুর রহমান, উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার জাহাঙ্গীর আলম, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম অফিসার ফাতেম জোহরা, সদর উপজেলা সমবায় অফিসার করিমুল হক, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান সরদার, শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র রক্ষা টিমের সভাপতি এসএম হাবিবুল হাসান প্রমুখ।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, ‘প্রতিবছর কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ১% শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান যে হারে ভূমি কমছে এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কোনো কৃষিজমি থাকবে না বলে আশংকা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষিখাতে চলে যাচ্ছে।’ বক্তরা আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য আমরা প্রচুর উর্বর জমি হারিয়েছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং আবাসনের কারণে হারিয়ে গেছে বিপুল পরিমাণ উর্বর জমি। অপরিকল্পিত উন্নয়ন রোধ করে ভূমির শ্রেণি বা প্রকৃতি ধরে রেখে পরিবেশ ও খাদ্যশস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা, কৃষিজমি ও কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগিক সুবিধার সুরক্ষা ও ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের আওতায় দেশের সব জমির শ্রেণি নির্ধারণ করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, আবাসন, নদী, সেচ, নিষ্কাশন, পুকুর, জলমহাল, মৎস্য এলাকা, বনাঞ্চল, সড়ক ও জনপথ এবং রেলপথ, হাটবাজার, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা, চা, উপকূলীয় অঞ্চল, পর্যটন এলাকা চিহ্নিত করে দিতে হবে।’ তারা বলেন, ‘কোনো আবাদি জমি অকৃষিখাতে ব্যবহার করা যাবে না। কেউ যদি এ ধরনের জমিতে শিল্প স্থাপন করে, তবে তাদেরকে কোনো সুবিধা প্রদান করা যাবে না। শিল্পপার্ক ছাড়া দেশের যেখানে সেখানে কোনো শিল্প কারখানা গড়ে তোলা যাবে না। কেউ কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহার করলে অর্থদন্ড ও কারাদন্ডের বিধান রাখতে হবে। দেশ ও দেশের জনগণকে টিকিয়ে রাখতে কৃষিজমি রক্ষার বিকল্প নেই। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে দেশে খাদ্যে উৎপাদন বাড়ছে, তবে যেভাবে অলক্ষ্যে কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে, তাতে সংকট দেখা দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দেশের মানুষের খাদ্য সংস্থান যে জমি থেকে হয়, তা রক্ষায় অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

সভায় আলোচনায় অংশ নিয়ে সদর উপজেলা সমবায় অফিসার করিমুল হক বলেন, ‘কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়া রোধে জমির শ্রেণি চিহ্নিত করে জোনিং পদ্ধতি চালু করতে হবে। জোনিং পদ্ধতি চালু করা গেলে কৃষি জমি সুরক্ষা করা সম্ভব হবে। এছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পতিত জমিকে কৃষি জমি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।’ সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় পানিতে লবণাক্ততা থাকবে এটা স্বাভাবিক। এজন্য জোনিং পদ্ধতি চালু করে প্রতিটি জমিকে আলাদা করতে হবে। খাদ্য সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে। মানুষ আগের তুলনায় বেশি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। সব কিছু পরিকল্পিতভাবে করতে না পারলে আগামীতে আমাদের কৃষি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়বে।’ সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি জমি কমবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের অল্প জমির সঠিক ব্যবহার করতে হবে। রাস্তার আশেপাশের জায়গা ও মৎস্য ঘেরের আইল ব্যবহার করতে হবে। কৃষিজমিকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। কৃষি জমির অপব্যবহার রোধ করতে হবে। প্রস্তাবিত কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন দ্রুত চূড়ান্ত করে কার্যকর করলে এটা সহজ হবে।’

happy wheels 2

Comments