জাতীয় বাজেট আলোচনায় বক্তারা: কৃষিখাতে বাজেট বাড়াতে হবে
বারসিকনিউজ ডেস্ক
বারসিক ও পবার উদ্যোগে আজ জাতীয় বাজেট-২০২১-২০২২: কৃষকের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে এবং বারসিক’র পরিচালক পাভেল পার্থ এর সঞ্চালনায় অনলাইন সভায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম,পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান, বানিপার সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, বারসিক’র পরিচালক এবিএম তৌহিদুল আলম, সৈয়দ আলী বিশ^াস, মানিকগঞ্জের জেলা কৃষি উন্নয়ন সংগঠনের সভাপতি করম আলী মাস্টার, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার নারী উন্নয়ন সংগঠনের সভাপতি সেলিনা বেগম, মানিকগঞ্জের বায়রার কৃষক-কৃষাণী সংগঠনের সভাপতি রাবেয়া বেগম, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ সিরাজুল ইসলাম, নেত্রকোনার কৃষক নেতা সায়েদ আহমেদ বারসিক’ বিমল রায়, শহিদুল ইসলাম, পার্থ সারথী পাল, বাচ্চুসহ প্রমুখ। আলোচনায় ধারণাপত্র পাঠ করেন বারসিক’র মানিকগঞ্জের অঞ্চলের কর্মসূচি কর্মকর্তা শিমুল বিশ্বাস।
অনলাইন সভায় বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘টাকার অংকে বিবেচনা করলে এবারের বাজেটে কৃষিখাতে বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে মোট শতাংশ হিসেব করলে প্রকৃতপক্ষে এবারে কৃষিবাজেট বাড়েনি। পূর্ববতী বাজেটের বিষয়টি বিবেচেনা করলে এবারের কৃষিতে বাজেট আরও বেশি গুরুত্ব পেতে পারতো। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, প্রতিবছর যে ভর্তুকি দেওয়া হয় সেটি খরচ হয় না। তাই সরকারকে ভাবতে এই ভর্তুকি যাতে সঠিকভাবে ব্যবহার হয়। কৃষিউপকরণের জন্য ভর্তুকির কিছু রেখে বাকিটা যদি কৃষকের হাতে নগদভাবে বিতরণ করা হয় তাহলে কৃষকরা উপকৃত হবেন এবং ভালোমত ব্যবহার করতে পারবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষিমূল্য কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে অনেকবার। এটি খুব দরকারি এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি গঠিত হলে কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতেন। এছাড়া কৃষকের কাছে যে ফসল সংগহ্র করা হয় সেটা যদি মোট উৎপাদনের ১০% হয় তাহলে কৃষকরা লাভবান হবেন।’ যে পদ্ধতিতে সরকার কৃষকের কাছ ধান সংগ্রহ করে সেটি পরিবর্তন করার প্রস্তাব করেন তিনি। তাঁর মতে, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ও অন্যান্য ফসল সংগ্রহ করতে হবে। ৫০ লাখ টান খাদ্য সংগ্রহ করা যায় এমন গুদাম তৈরির কথাও তিনি প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, ৫০ লাখ টন ধারণক্ষমতার গুদাম তৈরি করা হলে কৃষকের কাছ থেকে ধান ছাড়াও গম ও অন্যান্য ফসল সংগ্রহ করা যাবে। এতে কৃষকরা তাদের কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এছাড়া মৎস্য ও পশুসম্পদ খাতেও সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। কৃষি ও কৃষকের সার্বিক কল্যাণ কথা ভেবে মৎস্য ও পশুপালন খাতটিও ভর্তুকির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অন্যদিকে কৃষি ও কৃষকের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এই করোনাকালে কৃষিঋণ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে হবেএবং এই ঋণের সুদ অবশ্যই ৪% হওয়া উচিত।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘কৃষি ও কৃষক দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন এবং অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছে। এই করোনাকালেও কৃষকরা ঝুঁকি মোকাবিলা করে খাদ্য উৎপাদন করছেন। এজন্য দেশকে খাদ্যসঙ্কটে পড়তে হয়নি। সরকার ঘোষিত এই বাজেট কৃষি ও কৃষককে নানানভাবে প্রভাবিত করবে। কৃষকের লাভ ও লোকসান এই বাজেটের ওপর নির্ভরশীল। এই বাজেট আমাদের পরিবেশ ও জৈববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করবে। তাই বাজেটে সুনিদির্ষ্টভাবেই কৃষি ও কৃষকের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।
পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, ‘কৃষি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। করোনার এই সময়ে কৃষকদের অবদান মনে রাখতে হবে। কৃষকরা আমাদের সেবা দিয়ে আসছেন। তাঁরা যদি উৎপাদন না করতেন তাহলে আমরা অভুক্ত থাকতাম। তবে কৃষকের জন্য যে সহায়তা দেয়া হয় সেটা প্রান্তিক কৃষকরা পান না। তাই এদিকটাই সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। বিদ্যুূৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষকদের সাশ্রয়ী মূল্য দিতে হবে। কৃষি উপকরণগুলোর ওপর প্রণোদনায় যাতে কৃষকরা সরাসরি পান তা মনিটর করতে হবে।’ এছাড়া তিনি অঞ্চলভিত্তিক কৃষিপ্রণোদনা প্রচলন করার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভিন্ন। বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্নভাবে দুর্যোগের সন্মুখীন হচ্ছে এবং মোকাবিলাও করছে ভিন্নভাবে। তাই অঞ্চলভিত্তিক প্রণোদনা ব্যবস্থা করা হলে কৃষকরা উপকৃত হবে।’ তিনি জৈব কৃষির প্রচলন, বার্গচাষীদের বিনা জামানতে দেওয়া, কৃষিপণ্যের জন্য সংরণাগাড় তৈরি এবং ইটভাটায় কৃষিজমির টপ সইল ব্যবহার না করার দাবি করেন।
বানিপার সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের কৃষি নানানভাবে অবহেলিত। অকাল বন্যা ও নানান দুর্যোগের কারণে হাওর অঞ্চলে অহরহ ফসলহানি হচ্ছে। হাওরের কৃষির জন্য তাই প্রয়োজন একটি স্থায়ী পরিকল্পনা।’ এছাড়া তিনি হাওর এলাকার নদী খনন এবং জলাশয়ের লীজ বদ্ধ করা, এবং হাওরের ফসল উৎপাদনের জন্য গবেষণা করার দাবি জানান।
বারিসক’র পরিচালক এবিএম তৌহিদুল আলম বলেন, ‘আমাদের ঘন জনসংখ্যার দেশে খাদ্যনিরাপত্তা খুবই জরুরি। কৃষির পণ্যের ন্যায্যমূল্যের একটি জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করতে চাই। সেটি গঠিত হলে কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এতে করে কৃষিতে তরুণরাও আগ্রহ দেখাবেন।’
মানিকগঞ্জের জেলা কৃষি উন্নয়ন সংগঠনের সভাপতি করম আলী মাস্টার বলেন, ‘গতবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে এবারের কৃষি খাতের বাজেট তুলনামূলকভাবে কম। কৃষকের কথা শুধু মুখেই শোনা যায়, বাস্তবে কৃষকের কথা কেউ খুব একটা ভাবে না। এভাবে বাজেট কমাতে কমাতে একসময় কৃষি ও কৃষককে বিতারণ করা হবে। কৃষকরা হচ্ছেন খাদ্যযোদ্ধা। এই উপাধিটা আমরা চাই। এই খাদ্যযোদ্ধারা এখনও নানানভাবে বঞ্চিত, অবহেলিত।’মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার নারী উন্নয়ন সংগঠনের সভাপতি সেলিনা বেগম বলেন, ‘আমরা নারী কৃষক। কৃষক শুধু পুরুষ নয়; আমরা নারীরাও কৃষি কাজ করি। আমাদের নিজেদের জমি নাই। বিনা জামানতে কৃষি ঋণ দেওয়া হয় না। আমরা চাই কৃষি ঋণ বিনা জামানতে যাতে আমাদেরকে দেওয়া হয়।’ তিনি নারী কৃষকের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান।
অনলাইন সভায় অন্যান্যের মধ্যে আলোচনা করেন রাজশাহীর বিলনেপাল এলাকার কৃষক নেতা আব্দুল খালেক নেত্রকোনা উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি সৈয়দ বাচ্চু, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ সিরাজুল ইসলাম, বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম, অহিদুর রহমান, পার্থ সারথী পাল, বিমল রায়, কৃষক ইমান আলী, কৃষাণী রাবেয়া বেগম, কৃষকনেতা ইউসুফল আলী প্রমুখ।
অনলাইন সভায় বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়েছে,কৃষিপণ্যেও সংরণাগাড় তৈরি করতে হবে জাতীয় কৃষিমূল্য কমিশন গঠন করতে হবে কৃষকের জন্য পেনশন স্কিম চালু করতে হবে, কৃষককে খাদ্যযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, বাজেটে কৃষির ওপর বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে, নারীকেও কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, কৃষিজমিতে ইটভাটা করা বন্ধ করতে হবে, কৃষি ভর্তুকি সুষম বণ্টন করতে হবে, রাষ্ট্রীয়ভবে কৃষক সংগঠন করতে হবে, অঞ্চলভিত্তিক কৃষিপ্রণোদনা দিতে হবে, হাওর অঞ্চলের জন্য কৃষিতে আলাদা বাজেট বরাদ্দ করতে হবে, বজ্রপাতে মারা যাওয়া কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি।