বিশেষভাবে সক্ষম রাজীবুল ইসলামের জীবন সংগ্রাম
রাজশাহী থেকে রাফি আহমেদ
বৈচিত্র্যময় পৃথিবী নানাবিধ বৈচিত্র্যে ঘেরা। এই বৈচিত্র্যের ধারাবাহিকতা প্রতিটি মানুষের জীবনেই বিদ্যমান। যন্ত্রনির্ভর এ যুগে মানুষের জীবনও হয়ে উঠেছে অনেকটাই যান্ত্রিক। প্রতিনিয়ত মানুষকে করে যেতে হচ্ছে বেচে থাকার লড়াই।
এই বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক নির্ভীক যোদ্ধার গল্প বলবো আজ। যোদ্ধার নাম মো: রাজীবুল ইসলাম রাজীব। তার বাড়ি বরেন্দ্রভূমির তানোর উপজেলার সিন্দোকায় গ্রামের গায়েনপাড়ায়। চোখে দেখতে না পাওয়ার কারণে লোকে তাকে রাজীব কানা বলে ডাকে। জন্মগতভাবে সৃষ্টিকর্তা তাকে দৃষ্টি দেননি ঠিকই কিন্তু তাকে এক অসম প্রতিভার অধিকারী করে পাঠিয়েছেন এই দুনিয়াতে। রাজীব অত্যন্ত সুন্দর গান গাইতে পারেন। তার গান গাইতে তেমন কোন বাদ্যযন্ত্র লাগে না। শুধুই একটা কলসি চাই তার। তাহলেই তার সব সুর চলে আসে। কলসি বাজিয়েই তিনি রীতিমত প্রায় সব ধরনের বাদ্যের সুর তুলতে পারেন। খোলা গলায় কলসি বাজিয়ে তিনি যখন গান ধরেন তখন আশে পাশে কেউ আর তার কাছে ছুটে না এসে পারেন না। এতটাই মধুর করে গান করেন তিনি। নিজের চোখে না দেখে আর কানে না শুনে কেউ আন্দাজই করতে পারবে না তার গানের এই অসাধারণ প্রতিভা। একটানা ৩-৪টি গান করে যখন তিনি দুদন্ড বিশ্রাম নিতে চান তখন মুগ্ধ হওয়া শ্রোতামন্ডলি তাকে বারেবারে আবার গান শোনানোর অনুরোধ করে। কলসি ছাড়াও তিনি খালি গলায় অনেক ধরনের বাদ্যযন্ত্রের ন্যায় সুর করতে পারেন। আর সেই সুরের সাথে গান করেন। তার গান শুনে মনে হয় যেন আরো শুনি। এতটাই মধুর লাগে তার গান।
তিনি সব ধরনের গানই করতে পারেন। তবে তার পছন্দের গানের তালিকায় রয়েছে লোকগীতি, লালন, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি ও ভাটিয়ালি গান। এই গ্রাম বাংলার গানই তিনি বেশি করে থাকেন। তবে মাঝে মাঝে আধুনিক বাংলা ও হিন্দি সিনেমার গানও করেন দর্শকদের অনুরোধে। কোন ধরনের গানের প্রশিক্ষণ নেই তার। কখনো কারো কাছে গান ও শেখেননি তিনি। সম্পূর্ণ নিজের তাগিদে ও প্রচেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছেন দক্ষ। তিনি যখন গান ধরেন তার পূর্বে এফ এম রেডিওর ন্যায় বলে ওঠেন, এখন আপনারা শুনবেন রাজীব কানার গলায় বাংলা গান। এভাবেই তার এই প্রতিভা দেখে খুশি হয়ে এক ব্যক্তি তাকে একটি হ্যান্ড মাইক কিনে দিয়েছেন। এখন তিনি সেই হ্যান্ড মাইক নিয়ে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে গিয়ে সেই মাইক আর তার কলসি দিয়ে গান করেন। মানুষ খুশি হয়ে তাকে যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকেন। সেই অর্থ দিয়েই রাজীবের সংসার চলে কোনরকম।
পারিবারিক জীবনে রাজীবের দুইটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তার বড় মেয়ে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ৩ এ পড়ে। আর ছোট মেয়ে ক্লাস ১ এ। দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়েই রাজীবের সংসার। তারাই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। সে তার দুইটি সন্তানকেই উচ্চ শিক্ষিত করতে চান। সেই স্বপ্ন নিয়েই প্রতিদিন সকালে জীবিকার উদ্দেশ্যে কলসি কাধে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় এই রাজীব। এভাবেই দুঃখ দীনতায় কাটছে তার জীবন।
দেশের অনেক প্রতিভা জায়গা পায় আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ও টেলিভিশনের নানান অনুষ্ঠানে। কিন্তু রাজীবের মত এমন বিশেষভাবে সক্ষম মানুষগুলো জায়গা পায় না তাদের দৃষ্টিতে। তারা সুযোগ পায় না তাদের এই লুকায়িত প্রতিভার বিকাশ ঘটাবার। তারা পারেনা তাদের এই প্রতিভাগুলোকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। অথচ এদের মত মানুষগুলোর জন্যই আজও আমরা এই লোক সংস্কৃতি ও লোক গান সম্পর্কে জানতে পারছি। নতুন প্রজন্ম বাংলার গান শুনতে পারছে জানতে পারছে। এদের সংরক্ষণ ও বিকাশের প্রয়জোনীয়তা ব্যাপক। এধরনের প্রতিভাবান লোকসংস্কৃতি প্রেমী মানুষদের যদি পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত করা যায় তবে এই বাংলার হাজারো বছরের সংস্কৃতি অক্ষত রবে। এদেরকে করুণা নয় এদেরকে সম্মান করতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে আমাদের সংস্কৃতি।