‘জীবন যৌবন সায়রে ভাসাইছি’

নেত্রকোণা থেকে হেপী রায়

হাজার বছর ধরে নিজস্ব জ্ঞানে বিভিন্ন জাতের ফসল বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে আসছেন একজন নারী। যুগ যুগ ধরে পরম মমতায় নিজ পরিবারের সদস্যদের যত্ন করে পালন করছেন একজন নারী।

আমাদের দেশের যত জ্ঞানী গুনী মহামানব নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছেন- তাঁদের জন্মও তো সেই নারীর গর্ভেই। কারণ একজন নারীই পারেন গর্ভে সন্তান ধারণ করতে। শুধু গর্ভে সন্তান ধারণ করলেই তাঁর কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। সেই সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতেও তাঁকে কষ্ট করতে হয়। সন্তানকে লালন পালন করে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হয়। সন্তানের সুখই মায়ের সুখ, দুঃখেও কাতর হন। কিন্তু ভবিষ্যতে সেই সন্তানই যদি মায়ের দু:খের কারণ হয়, তখন তো আর কোনো কথাই থাকেনা।

ছোটবেলা থেকে একজন নারী পরিবার ও সমাজে নিগৃহিত হয়ে বড় হতে থাকে। শিশু কালে বাবার বাড়ি, বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি, আর বার্ধক্যে ছেলের বাড়িতে থাকতে হয়। তাঁর নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ঠিকানা প্রতিনিয়ত বদল হয়। অথচ যে ঘর নারী ছাড়া পরিপূর্ণ নয়, সেই ঘরেই নারীর কোনো মর্যাদা নেই। তাছাড়া বৃদ্ধ বয়সে এসে যদি ছেলের কাছে নির্যাতিত হয়ে বা অন্যের আশ্রয়ে থেকে, খেয়ে না খেয়ে একজন নারীকে দিন কাটাতে হয় তবে একে কি বেঁচে থাকা বলে? বার্ধক্য মানুষের জীবনে একটা স্বাভাবিক পরিণতি। সময়ের আবর্তে জীবনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে মানুষ এক সময় বার্ধক্যে পৌঁছে যায়। সময় পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয়না শুধু নারীর অবস্থানের।

IMG_20180905_123544

৯১ বছরের বৃদ্ধা জজের মা। লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের তিয়শ্রী গ্রামে বাস করেন। এই গ্রামেই তাঁর জন্ম। বিয়ে হয়েছিল পার্শ¦বর্তী পলাশহাঁটি গ্রামে। জন্মের পর নিজের খালার নামে নামকরণ করেছিলেন তাঁর মা। এই নামেই তিনি পরিচিত। পলাশহাঁটি গ্রামের আসন আলীর সাথে বিয়ে হয় জজের মা’র। জায়গা জমি তেমন একটা ছিলনা। স্বামী অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করতেন। তারপরও স্বচ্ছন্দে চলে যাচ্ছিল জীবন। বিয়ের পর এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম দেন তিনি। তখনো আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। ছেলে মেয়ে ও সংসার নিয়ে সুখেই ছিলেন। যুদ্ধের সময় অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করতে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর বাড়িতে গিয়ে মাঝে মাঝে হানা দিতো। তিনি ভয় পেতেন না, সাহসী ছিলেন। অনেক সময় তাদের গালাগালিও করতেন।

এক সময় দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু এই স্বাধীন দেশে আনন্দে জীবন কাটানোর সুখ তাঁর কপালে সইলোনা। কারণ মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন পরই তাঁর স্বামী মারা যায়। পিতৃহীন দুটি সন্তান নিয়ে তখন তিনি দিশেহারা। একদিকে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে, অন্যদিকে এলাকার লোকজনের অত্যাচারে তিনি অতিষ্ঠ। স্বামীর বাড়ির কেউ কোনো সাহায্য করেননি। তিনি যখন বিধবা হন তখন তাঁর বয়স খুবই কম। দেখতেও খারাপ ছিলেন না। অনেকেই বিয়ে করতে চাইতো। কিন্তু ছেলে মেয়ের ভরণ পোষণের দায়িত্ব কেউ নিতে চাইতোনা। আবার নির্জন পরিবেশে, জঙ্গলে ঘেরা পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে তিনি থাকতেন। এই সময়টা অনেক কষ্টে কেটেছে। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অনেকেই তাঁর অভাব আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে চাইতো। তিনি অনেক কৌশলে এসবের মোকাবেলা করতেন।

আমাদের সমাজ এমনই এক সমাজ, যেখানে একা একজন নারী দিন যাপন করতে পারেন না। পুরুষদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে তিনি নিজের ক্ষতি করেছেন। চেহারা তাঁর যেমনই ছিল, মাথার চুল ছিল দেখার মতো। যেমন লম্বা, তেমন ঘন, কালো। এই চুল দেখেই অনেকে প্রশংসা করতো। ঠিকমতো চুলের যত্ন নিতে না পারলেও চুলের সৌন্দর্য্য এতটুকু কমেনি। তিনি ভেবে দেখলেন, এই চুলই যদি না থাকে তবে তো কেউ আমাকে বিয়ে করতে চাইবেনা। এই ভেবে তিনি নিজের মাথায় লবণ মেখে রাখতেন, যাতে চুল পড়ে যায়। মাথার লবণ গলে গলে মুখ বেয়ে পড়তো। এভাবে লবণ গলা পানি পড়ে তাঁর চোখে সমস্যা দেখা দেয়। আবার মুখের ত্বকের বিভিন্ন অংশে কালো কালো ছোপ পড়ে চেহারার লাবণ্যতা কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়।

মাথায় লবণ মাখানোর ফলে আস্তে আস্তে তাঁর চুল পড়ে যেতে লাগলো। চেহারার লাবণ্যতাও এক সময় কমে গেল। এই অবস্থায় কেউ আর তাঁকে বিয়ে করতে চাইলোনা। অবশেষে তিনি ছেলে মেয়েদের মানুষ করায় মন দিলেন। মানুষের বাড়িতে ধান ভেঙে, রাস্তায় মাটি কেটে ছেলে মেয়ের খাবার যোগাড় করতে লাগলেন। নিজে কোনোদিন খেতেন, আবার কোনোদিন খাবার জুটতোনা। এভাবেই তাদের বড় করে এক সময় মেয়েকে বিয়েও দিলেন।

মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কয়েক বছর পর স্বামীর সাথে ঝগড়া করে মেয়েটিও আত্মহত্যা করে। জীবনে আরেকবার তিনি আঘাত পেলেন। তবুও তিনি ভেঙে পড়েননি। ছেলে তখনো তেমন বড় হয়নি। ছেলেকে নিয়েই মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার চালাতে লাগলেন। এক সময় ছেলে বড় হয়ে বিয়ে করে বৌ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকতে শুরু করলো।

স্বামীর ভিটায় আর তাঁর থাকা হলোনা। তিনি চলে এলেন তিয়শ্রী গ্রামে, প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেলো তিনি এখানেই আছেন। স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে বাবার বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। একে একে বাবা ও দুই ভাই মারা গেলেন। বড় ভাই মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের একমাত্র ছেলেটি মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। এই অবস্থায় একদিন সেই ছেলেটি তাঁকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। শেষ আশ্রয়টুকুও তিনি হারিয়ে ফেলেন। এরপর তাঁর এক গ্রাম সম্পর্কের ভাইয়ের বাড়িতে একটি ঘরে তিনি আশ্রয় নেন। এখনো সেখানেই আছেন। ছেলে নিজের সংসার নিয়ে স্বচ্ছন্দে আছে। কখনো তাঁর খোঁজ নিতে আসেনা। তিনি গেলেও ছেলের বৌ অত্যাচার করে তাড়িয়ে দেয়।

মাথা গুঁজার ঠাঁই তো হলো, কিন্তু খাবারের যে অভাব। শারীরিক অবস্থা, বয়স সব মিলিয়ে তিনি কারো বাড়িতে কাজ করে খেতে পারেন না। ভাইপো’র লাঠির আঘাতে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। তাই লাঠিতে ভর দিয়ে রাস্তার ধারে জন্মানো কচু গাছ থেকে লতা কুড়ান, কখনো বা লাকড়ি। এগুলো বিক্রি করে যা পান তাই দিয়ে চাল কিনে আনেন। সব্জী কেনা যায় না। তাই বেশির ভাগ সময় তেল আর লবণ দিয়ে পানি ভাত খেয়েই দিন কাটিয়ে দেন।

IMG_20180905_123653

“যে সন্তানের লাইগ্যা জীবন যৌবন সায়রে ভাসাইছি, অহন এই সন্তানেই আমারে সায়রে ভাসাইছে। নাতি নাতকরের মুখটাও দেখতাম পারিনা। কইলজাডা জ্বলে। হায়রে পুত আমার ! যে মায়েরে জীবনে শান্তি দিছোনা, মরলেও কব্বরো মাডি দিও না তুমি”। কতটুকু কষ্ট পেলে একজন মা’র মুখ থেকে এ ধরণের কথা উচ্চারিত হয়।

গ্রামের প্রতিবেশিরা মাঝে মাঝে খোঁজ খবর রাখেন। বিধবা ভাতার একটি কার্ড আছে তাঁর। প্রতি তিন মাস অন্তর ১৫০০/ (এক হাজার পাঁচশত) টাকা করে পান। এই টাকা পেলে তখন মাছ, তরকারী কিনতে পারেন। তবুও বেশি দিন চলেনা। একা হলেও তিনি মানুষ। অন্য সব মানুষের জীবন যাপন করতে যা প্রয়োজন হয়, সে সমস্ত চাহিদাতো তাঁরও আছে ? শরীরে যখন খুব ব্যথা হয় তখন ওষুধ না খেয়ে থাকতে পারেন না। তিন বেলা ভাত জোটেনা, ওষুধ কিনবেন কি দিয়ে?

কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কোন দূরে তাঁর দৃষ্টি যেন হারিয়ে যায়। হয়তো তাঁর ফেলে আসা দিনের কষ্টের স্মৃতি রোমন্থন করেন। আর ভাবেন, কবে আল্লার নজর পড়বে তাঁর দিকে। কারণ এখন তিনি মরলেই বাঁচেন। কষ্টের জীবনের বোঝা আর বইতে পারছেন না।
যে দেশে মাটির দেবীকে শত উপাচারে পূজা করা হয়, সে দেশে রক্ত মাংসে গড়া এক অবয়ব না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। যে দেশে ধনী ঘরের দুলালরা আনন্দ করতে গিয়ে মুহুর্তেই লাখ টাকা খরচ করে, সে দেশে অসহায় নারী লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড়ের অভাবে পাটের ব্যাগ গায়ে জড়িয়ে রাখেন। তারপরও কি আমরা বলতে পারি যে আমরা সভ্য দেশের নাগরিক? আমরা একজন অসহায়, দরিদ্র মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে পারিনা। একজন জজের মা নয়, প্রতিটি গ্রামে এমন অনেক জেেজর মা আছেন, যাদের জীবনে সুখ বলে কিছু নেই। তাঁদের কষ্টের কথাগুলো আমাদের কাছে গল্প বলে মনে হয়। শোনার পর কিছুক্ষণ হয়তো রেশটা থাকে, পরক্ষণেই ভুলে যাই। জজের মায়েদের কষ্ট শেষ হয় না।

happy wheels 2

Comments