নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী আমতলার মেলা
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
চৈত্রের গা পোড়া রোদ, কিছুসময় বসলে শরীরের উপর কালো আবরণ পড়ে যায়, মাঝে মাঝে তৃষ্ণার্ত কাক কা কা করে উঠে। এমন রোদ গা পোড়াতে কারো ভালো না লাগলে, চৈত্রের এ রোদ দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠে কুমার পাড়ার সিতা রানী পালের মুখে। আকাশে মেঘের ঘোড় ঘোড় ডাক শুনলে বিরক্ত হয়। চৈত্রে এ রোদের সাথে নির্ভর করে চৈত্র সংত্রান্তির মেলার প্রস্তুতি।
চৈত্র্য সংক্রান্তির দিন আমতলা বাজারের কয়েক গজ দূরে হিন্দুদের শশ্মান ঘাট তার সামনে খোলা মাঠে বসে মেলা। চৈত্র্য সংক্রান্তির পর বৈশাখে প্রথম দিন থেকে নেত্রকোনার বিভিন্ন গ্রামে ছোট ছোট মেলা চলতে থাকে বৈশাখ মাসজুড়ে। আমতলায় এক সময় হিন্দুদের এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল । হিন্দু ধর্মের লোকেরা এক সময় এ মেলার আয়োজন করলেও এখন সকল ধর্মের লোকেরাই অংশগ্রহণ করে থাকেন। কবে, কখন প্রথম এ মেলার শুরু হয়ে ছিল তা ইতিহাস জানা না গেলেও শত বছর ধরে চৈত্রের শেষ দিন এ মেলার হয়ে আসছে।
আমতলা বাজারে খুব কাছে, কামার, কুমোরদের পাড়া। তার সাথে জেলে পাড়া, এর পাশে মুসলিম কৃষক পরিবারও বাস করে। ভিন্ন ভিন্ন পেশার পরিবারগুলো এখই সাথে বসবাস করে আসছেন শত শত বছর ধরে। আমতলা বাজারের চারপাশ ঘিরে থাকা কামার, কুমোর, জেলে, কৃষক পরিবারগুলোর সাথে চৈত্র সংক্রান্তির এ মেলা যোগসূত্র বহু বছরের পুরনো। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন আসছে সব কিছুর। পরিবর্তন এসেছে জীবন ও জীবিকার। একসময় আমতলা মেলার মূলে ছিল কুমার পাড়ার তৈরি মাটির হাড়ি,পাতিল, খেলনা। ভালো মানের দা, কুড়াল, কাচি, কিনার জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটে এসেছে লোকজন। নৌপথে চুড়ির ঝোলা নিয়ে এসেছে বেদের দল।
আমতলা কুমার পাড়া বর্তমানে ৩৫টি পরিবার বাস করে। একসময় প্রতিটি পরিবারের প্রধান পেশা ছিল মাটির তৈরি উপকরণ বিক্রয় করে। নারীরা বাড়িতে মাটির হাড়ি, পাতিল তৈরি করে, পুরুষ সদস্যরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করে। একসময় নেত্রকোনা ধনী দরিদ্র সকল পরিবারেই মাটির তৈরি থালা, ঢাকনা, দুধের পাতিল ব্যবহার করতেন। পানি নিরাপদ ও ঠান্ডা রাখার জন্য ব্যবহার করতেন মাটির কলস। আমতলার কুমার পাড়া চিত্র এখন বদলে গেছে। সময়ের প্রয়োজনেই পেশার পরিবর্তন ঘটেছে। বাজারে এখন প্রায় সকল জিনিস তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে, যা পরিবেশের যেমন ক্ষতি করছে তেমনি মানব দেহে সৃষ্টি করছে বিভিন্ন রোগবালাই। বর্তমানে ৪টি পরিবার সারাবছর মাটির উপকরণ তৈরির কাজটি করে থাকে। কিন্তু মেলার জন্য প্রতিটি পরিবারই মাটির খেলনা তৈরি করে। যা থেকে কিছু অর্থ চলে আসে দরিদ্র পরিবারগুলোতে। তবে যে পরিশ্রম করে তারা মাটির খেলনাগুলো তৈরি করে তা বিক্রি করতে হয় স্বল্প লাভে। পূর্ব পুরুষের পেশা ও নিজের শখের বসেই পরিবারগুলো মেলার জন্য খেলনা তৈরি করে।
প্রায় দুই শতাধিক দোকান বসে মেলাতে। আমতলা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ছাড়িয়ে আশপাশের ইউনিয়ন থেকেও বিভিন্ন দোকানদার দোকান নিয়ে আসে মেলায়। মাটির খেলনা, ছোট ছোট কসমেটিক, কামারদের তৈরি বিভিন্ন কৃষি উপকরণ, বেতের তৈরি মাঁদুরের দোকান, বাঁশের তৈরি কুলা, ডালা, চালুন, মাছ ধরার উপকরণ দোকান নিয়ে বসে মেলায়। শিশুদের জন্য বেলুন, রঙ বেরঙের বাঁশি, লেইজ ফিতার বিক্রয় করে ফেরিওয়ালারা। এছাড়াও ১০ থেকে ১২ সদস্যর বিশিষ্ট বেদের দল এখনও মেলায় চুড়ির দোকান নিয়ে বসে।
মেলা এক পাশে শুধু বসে খাবারের দোকান। বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার যে খাবারগুলো পরিবেশন করা হয় এই দোকানগুলোতে। এক সময় বাঙালিদের মধ্যে অতিথি আপ্যায়নের জন্য যে খই, মুড়ি, চিড়া খাবার রেওয়াজ ছিল, আজকাল তা আর দেখা যায় না। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড রোদে আখের গুড় দিয়ে খই ভিজিয়ে খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে, ঘরে পাতা দই দিয়ে হাতে ভাজা মুড়ি খেলে পেঠের পিড়া কমে। সেই নিয়মগুলোর সাথে জড়িয়ে ছিল নারীদের বিভিন্ন লোকায়ত চর্চা। যা এখন আর মানা হয় না এগুলো। নতুন নতুন আধুনিক খাবার, আমাদের শরীরের জন্য কতটুকু উপকার বা অপকার করছে সে নিয়ে কারো মাথা ব্যথ্যা নেই।
সেই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী খাবার আমতলা গ্রামের মেলার প্রধান আকর্ষণ। আখের গুড়ের খেলনা, বিন্নি ধানে খই, আখের গুড় আর খই এক সাথে জ্বাল দিয়ে বানানো হয় উকড়া। বস্তা ভর্তি করে অর্ধ শতাধিক দোকানে শুধু খই, বিন্নি, চিনির তৈরি বাতাসা, আখের গুড়ের, চিনির তৈরির খেলনা, গুড় খই উকড়া বিক্রয় করে। শিশুদের আকর্ষণে খেলনায় তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের জীব জন্তু, ফুল, ফলের নকশা, এ যেন বাংলার মানুষে প্রাণবৈচিত্র্য প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ।
এলাকার হিন্দু পরিবারগুলো একসময় খই, মুড়ি নিজেরা বাড়িতে তৈরি করে বাজারে বিক্রয় করত। কিন্তু এখন দু একটি পরিবার মেলাতে হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রয় করলেও খই, বিন্নিগুলো আসে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা থেকে আসে। অধিকাংশ খই, বিন্নি আসে কিশোরগঞ্জ জেলার আঠারো বাড়ি থেকে।
গ্রামের অধিকাংশ পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল একসময় বৈচিত্র্যময় ধান উৎপাদনের জন্য এলাকার সুনাম ছিল দূর দূরান্ত পর্যন্ত। গ্রাম বাংলা অন্যান্য গ্রামের মতো আমতলা গ্রামের চিত্রও বদলে গেছে। বর্তমানে অধিকাংশ পরিবার উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করে। দেশীয় ধান চাষ করা কৃষকের সংখ্যা খুব কম। হাতে ভাজা মুড়ি, বিন্নি, খই ধান এখন আর কৃষকরা চাষ করে না। ফলে বর্তমানে মেলার অধিকাংশ খাবারগুলো ভিন্ন গ্রাম থেকে আসে।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে মেলা। সকালে মেলা কিছুটা ভিড় না থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেলা জমে উঠে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বাবা, দাদা, নানার হাত ধরে মেলায় চলে আসে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ব্যাগ ভরে খেলনা, খাবার নিয়ে ফিরে যায়। ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম, ভিন্ন ভিন্ন পেশা, ধর্মের ভিন্নতা, ধনী ,দরিদ্র সকল ভেদাভেদ ভুলে বছরের এ একটি দিন যে সকলকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু তারপরও কোথাও যেন একটি সামাজিক অসংগতি, বৈষম্য চোখে পড়ে এ মেলায়। আমতলার এ মেলায় প্রায় অংশগ্রহণকারী সংখ্যা হাজার ছাড়ালেও যাদের তৈরি উপকরণ এ মেলা বিক্রয় হয়, যারা রোদে পুড়ে গায়ে রঙ তামাটে করে মেলাকে আকর্ষণীয় করে তুলে সেই নারীরা মেলায় অংশগ্রহণ করেন না। মেলায় নারী বলতে ভিন্ন গ্রাম থেকে আসা বেদের দল। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাইরে যাবে, বাইরে ক্রয় বিক্রয়ে কাজটি যেন শুধু পুরুষদের মানায়! ২০১৯ সালেও আমতলার এ ঐতিহ্যবাহী বিশাল মেলা কিছু পরিবর্তন হয়নি।
নেত্রকোনা সদর থেকে কিছু নারী, কিশোর-কিশোরী মেলা দেখতে গেলেও এলাকার কিশোরী বা নারীরা মেলায় অংশগ্রহণ করেনা।ঘরে বসে মেলার উপকরণ তৈরি আর গল্প শুনাই যেন তাদের কাজ! যে নারীরা যুগ যুগ ধরে বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন সেই নারীরা কেন শুধু ঘরে বসে সমাজে বিভিন্ন ধরনে উৎসব গল্প শুনবে? এ কি পুরুষদের তৈরি সামাজিক বাধা, নাকি নারীরা এখনো পুরুষদের সাথে সমান তালে সমাজের পথে হাটার মত আত্মবিশ্বাস নিজের মধ্যে তৈরি করতে পারেনি?