শিল্পী জীবন ধুপ সম
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল বিশ্বাস
দেশে কোভিড জনিত সমস্যা কেটেছে অনেকটা। চলে এসেছে করোনা ভাইরাসের টিকা। অধিকাংশ পেশাজীবী মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাভাবিক হলেও স্বাভাবিক হয়নি সাংস্কৃতিক কর্মীদের জীবন। তাইতো মৃদাঙ্গ বাদক লন্ঠুদার ফেরা হলো না নিজের ছন্দে। চলে গেলেন অজানার দেশে। সিংগাইর উপজেলার স্বরূপপুর গ্রামের প্রদীপ বিশ্বাস (লন্ঠু) একজন প্রসিদ্ধ মৃদাঙ্গ বাদক। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবদান রাখার পাশাপাশি বারসিক’র প্রবীণ অধিকার সুরক্ষায় সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযানের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। একদিন এ শিল্পীর মৃদাঙ্গের তালে নদীর ঢেউ খেলতো, মুগ্ধ হতো হাজারও মানুষ। গতকাল থেমে গেল তার নিজের জীবনের সকল ছন্দ। আজ তিনি নিজেই তরঙ্গহীন হয়ে ধরা ছোয়ার বাইরে চলে গেলেন।
শিল্পী জীবন ধুপ সম। নিজে পুড়ে অন্যকে গন্ধ বিলায়। জাত শিল্পীরা এমনই হয়। নিজের সুখ সাচ্ছন্দের কথা না ভেবে অন্যকে আনন্দ দিতে বেশি ব্যস্ত থাকেন। যারা খুব অল্পতেই খুশি থাকে। স্বরূপপুর গ্রামের প্রদীপ বিশ্বাস (লন্ঠ’) ছিলেন এমনই একজন জাত শিল্পী। মুখে সর্বদাই হাসি জড়িয়ে থাকতো। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তেমন ভালো ছিল না। একটি মাত্র ছেলেকে বিএ পাশ করিয়েছেন হাতের জাদুময়ী ছন্দের বিনিময়ে অর্জিত অর্থে দিয়ে। ছেলেকে একটি ঔষুধের দোকান করে দিয়েছেন। হয়তো সামনের দিনগুলো সোনালি আলোতে ভরে উঠতে পারতো তাঁর। কিন্তু কিছুদিন আগে তার একটা স্ট্রোক হয়। অনেকে মনে করছেন করোনার কারণে বর্তমানে গানবাজনা বন্ধ। ছেলের দোকান নির্ভর সামান্য আয়। সব মিলিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তবে তার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তিনি অনেক আগে থেকেই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এখন পর্যন্ত রোগ সনাক্ত না হলেও মনে করা হচ্ছে তিনি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। সর্বদাই হাসিখুশি থাকতেন বিধায় এতদিন বোঝা যায়নি।
মাত্র কয়েক মাস আগের কথা। দেশ তখন কোভিড-১৯ এর কারণে স্তব্ধ। কোন সভা সমাবেশ, গান বাজনা করা সম্ভব ছিলো না। সেই মুহুর্তে সাংস্কৃতিক কর্মীদের দুরবস্থার কথা ভেবে বারসিক থেকে অনলাইন ক্যাম্পেইন শুরু করা হয়। এ ক্যাম্পেইন এর ফলে এগিয়ে আসেন কিছু সুহ্রদ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। সম্মানিত করা হয় সিংগাইর এলাকার অর্ধশতাধিক কন্ঠশিল্পী এবং যন্ত্রশিল্পীদেরকে। সম্মাননা উপলক্ষে বারসিক’র পক্ষ থেকে স্বল্প পরিসরে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। কোভিডের কারণে কয়েকমাস গৃহবন্দী থাকার পর উক্ত অনুষ্ঠানে পাগলের মত খোল বাজিয়েছিলেন লন্ঠুদা। তিনি যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্য এক জগতে। কে জানতো বারসিক এর সাথে এটাই হবে তার শেষ সঙ্গ। এর কিছুদিন পরই তার স্ট্রোক হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থতার পর গতকাল সকালে তিনি সকলের মায়া ত্যাগ করে ইহলোক ত্যাগ করেন।
দেশ থেকে কোভিড সমস্যা কেটে যাবে একেবারে। শিল্পীরা আবার মুক্ত আকাশে গান গেয়ে উঠবে। মুগ্ধ হবে হাজারো জনতা। শুধু সেখানে খুজে পাওয়া যাবে না প্রদীপ বিশ্বাস লন্ঠুর মত গুণী শিল্পীদের যারা কোভিডজনিত দৈন্যতার কষাঘাতে আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছেন। তাই সাংস্কৃতিক জগতের এসব গুণী মানুষকে রক্ষার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের হাত বাড়িয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।