একজন উদ্যোগী তরুণ বিশ্বনাথপুরের মো. মুমেন
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
নেত্রকোনা জেলার আমতলা ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের মো. মুমেন একজন উদ্যোগী তরুণ। মুমেনের বৈচিত্র্যময় জীবন চলার পথ যে কোন সাধারণ মানুষের জীবনকে কর্মময় করে তুলতে উৎসাহিত করবে। তাঁর ছোট ছোট উদ্যোগ যেমন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে সেই সাথে সহজে হেরে যাওয়া, হার মেনে নেওয়া নতুন প্রজন্মকে সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেবে। মুমেনের জীবনে কিছু গল্প জেনে নিই।
মুমেন খুব সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে। চার ভাই, তিন বোনের সংসার ছিল একসময়। বর্তমানে ৩ ভাই বিয়ে করে বাড়িতেই আলাদা সংসার করেন। দুই বোনও বিয়ে হয়েছে। মুমেনের বড় এক বোন শারীরিক প্রতিবন্ধি। মা, বাবার, প্রতিবন্ধি বোনকে নিয়ে মুমেনের বর্তমান সংসার। পড়াশুনা কম করায় ছেলেবেলা থেকে কৃষক বাবার হাত ধরে কৃষিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। কৃষিকে কেন্দ্র করে জীবনে সফলতা অর্জনের লড়াই শুরু করেছে মুমেন।
বিশ্বনাথপুর গ্রামের রাস্তার পাশে বাড়ি রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া বা যান বাহনে চলাচলের সময় পথচারিদের সহজে মুমেনের সবজি ক্ষেত চোখে পড়ে। খুব অল্প জায়গায় টমেটো, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন লাগানো হয়েছে সারি করে, ক্ষেতের চার পাশে মাচা বেঁদে লাগানো হয়েছে লাউ, সিম গাছ। তার একপাশে ছোট পুকুরপাড়ে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পেঁপের গাছ। পুকুর পাড়ে পেঁপে গাছে মাঝে মাঝে লাগিয়েছে অড়হর কালাই। আমতলা ইউনিয়নের খুব কম গ্রামে এ ধরনে অড়হর কালাই চোখে পড়ে।
রাস্তা থেকে দু কদম হেটে বাড়িতে ঢুকলে বাড়ির চারপাশে না ধরনের ফলের গাছ দেখতে পাওয়া যায়। ২৩ বছর বয়সী এ উদ্যোগী তরুণ নিজের ইচ্ছে ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজের জীবন বদলানোর চ্যালেঞ্জে নেমেছেন। তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে, রয়েছে পরিবেশবান্ধব চর্চা।
একজন আদর্শসবজি চাষি: মুমেন সারাবছর ১০শতাংশ জমিতে সবজি চাষ করেন। চলতি মৌসুমে টমেটো, মরিচ, বেগুনের পাশাপাশি চাষ করেছেন পেঁয়াজ, রসুন, যা থেকে নিজের পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রয় করতে পারেন ।
বৈচিত্র্যময় ফলের গাছ রোপণ: গাছ লাগানোর শখ ছেলেবেলা থেকে মুমেন যেখানে ভালো মানের ফলের গাছের সন্ধান পান সেখানে ছুটে যান, সংগ্রহ করেন। নিজেই যতœ করে বাড়ির চারপাশে রোপণ করে। বর্তমানে তাঁর বাড়িতে পাঁচ ধরনের আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জলপাই, চালতা, লেবু, বড়ই আপেল, কমলা, আতা ফলের গাছ রয়েছে।
ফিশারী ও পুকুরে স্থানীয় জাতের মাছ চাষ: একসময় তাঁর বাবার ছোট পুকুরে মাছ চাষ করে নিজেদের পরিবারের খাবার চাহিদা পূরণ করতেন। মাছ চাষে ভালো অর্থ উপার্জন সম্ভব বিধায় নিজের উদ্যোগে ধানী জমিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন। বর্ষা মৌসুমে যত দিন পানি থাকে মাছ চাষ করে শুকনো মৌসুমে আবার ধান লাগিয়ে দেন। গত বছর মাছ বিক্রয় থেকে আয় করেছে ৮৫ হাজার টাকা।
মুমেন ফিশারী স্থাপনের পর বড় সমস্যা পড়ে পাড় ভেঙ্গে পড়া। পাড় ভাঙ্গা রোধে লাগিয়ে দেন পেঁপে গাছ কিন্তু এরপরও পাড় ভাঙ্গা বন্ধ হয় না। এরপর অন্য গ্রাম থেকে খাওয়ার জন্য আনা অড়হর কালাই ছিটিয়ে দেন পুকুরের চার পাশে । অল্প সময় বেড়ে উঠে গাছ। অড়হর গাছের শিকরগুলো পাড়ের মাটিগুলো ধরে রাখে। ফলে বন্ধ হয় পাড় ভাঙ্গা।
এ প্রসঙ্গে মুমেন বলেন, ‘পুকুরে পাড়ে মাঠি ঙেঙ্গে যাওয়া বন্ধে অড়হর কালাই খুবই উপকারী এ অড়হর কালাইয়ের শিকড়গুলো মাটি ধরে রাখে। সেই সাথে এর পাতা পানিতে পড়ে মাছে খাদ্য তৈরি করে। রেনটি বা অন্যান্য গাছে পাতা থেকে পানিতে গ্যাস তৈরি করে যা পুকুরে পানি দূষণ ও মাছের ক্ষতি হয় কিন্তু অড়হর কালাই পানি ভালো রাখে।’
এ সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রবীণ কৃষক আব্দুল কাদির বলেন, ‘অড়হর পাতা খেলে খিদে বেড়ে যায়। এর ডাল খেলে পেট ভালো থাকে, শরীরিক ঠান্ডা থাকে, জন্ডিস হলে অড়হর কালাই এর পাতা রস খেলে উপকার হয়। অড়হর কালাই পুষ্টিকর খাবার। ভেজে বা ডাল রান্না করে খেলে শরীরে পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।’
মুমেন চলতি বছর প্রায় ২০ কেজি অড়হর কালাই তুলেছেন পুকুর পাড়ের গাছ থেকে, যা নিজ বাড়িতে ডাল রান্না করে খাওয়ার জন্য অর্ধেক রেখে বাকি বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অনেক ফিশারী মালিক তাঁর কাছ থেকে বীজ চেয়েছেন। অন্যদিকে মুমেনের রয়েছে ছোট নার্সারি। এ নার্সারি থেকে সারাবছর নিজের বাড়িতে নানা ধরনে গাছের চারা করে নিজের বাড়িতে ও প্রতিবেশিদের মাঝে বিক্রয় করে আয় করেন তিনি।
জৈব কৃষি চর্চাকারী: -নিজের বাড়িতে জৈব সার তৈরি করে নিজের সবজি ক্ষেতে দিয়ে থাকেন। ফলে তার উৎপাদিত সবজি এলাকাতে চাহিদা রয়েছে। সে সাথে উৎপাদন খরচও কমছে। নিজের বাড়ির বাইরে তিনি প্রতিবছর ধান, গম, ভুট্টা চাষ করে এলাকায় বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করেন। এতে করে এলাকার অন্য কৃষকদের মধ্যেও আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
মুমেন গাছ গড়িয়া যুব সংগঠনের সদস্য। পরিবেশবান্ধব চর্চা বৃদ্ধি, সামাজিক সমস্যা সমাধানে যুবদের সংগঠিত করার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে কৃষিতে আগ্রহ বৃদ্ধিতে কাজ করছে সংগঠনটি। সংগঠনে সহযোগি সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বারসিক।
প্রাণীসম্পদ পালনেও আগ্রহ রয়েছে মুমেনের। সারাবছর বাড়িতে গরু, হাঁস, মুরগি পালন করেন। ফলে ডিম, দুধের চাহিদা পূরণে বাজারের উপর নির্ভর করতে হয় না। মুমেন এ ধরনে কাজ যুব সংগঠনের সদস্যদের উৎসাহিত করে। ফলে অনেক যুব নিজেরা সঞ্চয় করে গরু, ছাগল পালন শুরু করেছে ।
মাত্র ২৩ বছরে এ উদ্যোগী তরুণ মাটিকে ভালোবেসে, মাটিকে কাজে লাগিয়ে জীবন পরিবর্তনের যে লড়াই শুরু করেছেন, তা এলাকার যুবকদের মধ্যে কৃষিতে আগ্রহ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। এ ধরনে উদ্যোগী যুবদের কাজ অন্য যুবদের যেমন নতুন চলার পথ দেখাবে সেই সাথে গ্রামে খাদ্যনিরাপত্তা, প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং বাজার নির্ভরশীলতা কমানোর মধ্য দিয়ে এক সুন্দর স্বনির্ভর গ্রাম তৈরিতে ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি।