করোনাকালে পরিবেশ ভাবনা
ঢাকা থেকে মো: জাহাঙ্গীর আলম:
পরিবেশ আর উন্নয়ন যে বিচ্ছিন্ন নয় তার উপযুক্ত উদাহরণ হলো কভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস। পরিবেশের উপর আঘাত করার কারণে চীনে ২০০২ সালে সার্স ভাইরাসের আবির্ভাব হয়েছিল। যে কোনো ধরনের অবকাঠামে তৈরি, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, অস্ত্রের গবেষণা উন্নয়নের পরিচায়ক হলেও, তা আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। পরিবেশকে ক্ষতি করে কোনো উন্নয়ন স্থায়ীত্বশীল হয়েছে এমন উদাহরণ আমরা দেখতে পাই না।
তথাকথিত উন্নয়নের চাপে ইতোমধ্যে আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতি আজ ধ্বংসের পথে। জীববৈচিত্র্য ও বাস্ততন্ত্র বিষয়ক বিজ্ঞান নীতি সম্পর্কিত আন্তঃসরকার-এর তথ্য মতে পৃথিবীতে ১০ লক্ষ জীব প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশেই এক সময় ২০ হাজার প্রজাতির ধানের চাষ করা হলেও এখন মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি ধানের চাষ হতে দেখা যায়। বাংলাদেশে জলাশয়ে এক সময় ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেলেও এখন মাত্র ১২২ প্রজাতির মাছ বিভিন্ন হাওর বাওর ও মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া যায়। এই রকম হাজারো প্রাণীর বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে আমাদের এই বাংলাদেশে।
তথাকথিত উন্নয়ন, নগরায়ন, শিল্পায়নের ফলে আমাদের এই সবুজ পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ধ্বংস করে ফেলেছি আমাদের জলাভূমির বিশাল জলজ প্রাণী, অধিক উৎপাদনের নামে বিষাক্ত করে ফেলেছি আমাদের ঊর্বর মাটি এবং দূষিত করেছি আমাদের বাতাস। আমাদের প্রকৃতিকে উন্নয়ন বিবেচনায় না রাখার কারণে প্রকৃতি আজ আমাদের প্রতি রুষ্ট। আমরা সচরাচর জীবজগত বলতে আমরা শুধু দৃশ্যমান মেরুদ- জাতীয় প্রাণী যেমন হাতি, বাঘ, ভালুক,পাখি, বানর, কুমির, ডলফিন মাছ জাতীয় প্রাণী বুঝে থাকি। পরিসংখ্যান বলে, জীবজগতে মেরুদ-ী জাতীয় প্রাণীর সংখ্যা মাত্র ৩.২৬ শতাংশ, অমেরুদ-ী জাতীয় প্রাণী ৭৭.১৯ শতাংশ এবং আর এর পড়েই রয়েছে উন্নত বৈশিষ্টের উদ্ভিদ, যেগুলো জীবজগতের ১৪.৪৯ শতাংশ। বাকিগুলো হলো এককোষী জীব, ফানজাই এবং অন্যান্য অনুন্নত জীব। আমাদের উন্নয়ন কর্মকা-ের কারণে প্রাণীজগতের এই বিশাল ভা-ার দিন দিন সংকুচিত।
জাতিসংঘের শান্তিমিশনে কর্মরত আমাদের এক পুলিশ বন্ধু কেনিয়ার জাতীয় চিড়িয়াখানা দেখে আকাশ থেকে পড়েছিলেন। তার বর্র্ণনায়, নগরের শেষ দেয়ালটা গিয়ে ঠেকেছে জাতীয় চিড়িয়াখানার দেয়ালে। শব্দ দূষণ আর বাযু দূষণে ওষ্ঠাগত প্রাণীদের জীবন। চিড়িয়াখানায় প্রাণীর সংখ্যা হাতে গোনা। যা অবশিষ্ট আছে, তাও খাবার না পেতে পেতে শুকিয়ে হাড্ডিসার। অথচ আফ্রিকার এইসব দেশেই অবশিষ্ট রয়েছে পৃথিবীর বন্যপ্রাণীগুলো। এই যদি হয় প্রাণীর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তাহলে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হতে বাধ্য।
আমরা অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাই প্রস্তর যুগে বাস্ততন্ত্রে মানুষের যে ভূমিকা ছিল, আণবিক যুগে এসে তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ তখন ছিল বাস্ততন্ত্রের অংশ আর বর্তমানে মানুষ হয়ে উঠেছে বাস্ততন্ত্রের নিয়ামক। প্রকৃতির প্রতি মানুষের এই নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণে রুষ্ট হয়েছে আমাদের প্রকৃতি। যার কারণে আজ প্রাণ-প্রকৃতির মানুষের সহায়ক না হয়ে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত সংক্রমিত সার্স, মার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, নভেল করোনাভাইরাসের উৎপত্তি এবং সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া আম্ফান, বুলবুল, মহাসেন, সিডর, আইলা, সাইক্লোন, ঘূর্ণীঝড়ের মাধ্যমে প্রকৃতি আমাদের বার্তা দিয়েছে নতুন করে ভাববার। প্রকৃতি আজ বিপন্নপ্রায়। এই প্রকৃতির মধ্যেই এই ভাইরাসগুলো হাজার বছর ধরে বিদ্যমান ছিল কিন্তু তারা এত দিন মানুষের জন্য বিধ্বংসী হয়ে ওঠেনি। অনেক প্রাণীই তাদের শরীরে বিপজ্জনক ভাইরাস বহন করে কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে এসব ভাইরাস এক লাফে মানবদেহে চলে আসতে পারে না। এই ভাইরাস রূপান্তরের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করতে পারে। নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটিই ঘটেছে। আমাদের পুঁজিবাদী দৃষ্ঠিভঙ্গীর কারণে আমরা বাদুর, সাপ, প্যাঙ্গোলিনের মতো বন্যপ্রাণী ধরে এনে পণ্য বানাচ্ছি এবং এই পণ্য থেকেই এই ভাইরাস মানব দেহে সংক্রমিত হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
দশ হাজার বছর আগে মানুষ উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতো আর এখন মাত্র ৪টি শস্য বিশ্বের মানুষের খাদ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তখন মানুষ ছিলো মাত্র এক ভাগ, বন্যপ্রাণী ছিলো ৯৯ ভাগ। এখন মানুষ হয়েছে ৩২ ভাগ, গবাদি প্রাণী হয়েছে ৬৭ ভাগ আর বন্যপ্রাণী মাত্র ১ ভাগ। কোথায় নিয়ে গিয়েছি আমাদের বন্যপ্রাণীগুলোকে।
বিশ্বায়নের প্রভাবে মানুষ মানুষের কাছাকাছি এসেছে বটে কিন্তু এর প্রভাবে পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই কিন্তু মানুষ যে এই বাস্তুতন্ত্রের অংশ সেটা ভুলে যাওয়ার কারণে তার মাশুল গুনতে হচ্ছে আমাদের। মানুষের এই কাছাকাছি আসার কারণে রোগ জীবাণু এক স্থান থেকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেছে অতি অল্প সময়ে। ফলে স্থবির আমাদের অর্র্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-। এই ভাইরাস পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। এই ভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশী প্রভাব পড়েছে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের উপর। করোনার থাবায় আজ আক্রান্ত প্রিয় পৃথিবী। অথচ প্রকৃতি ফেলছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। আমরা যখন ঘরবন্দী, প্রকৃতি তখন সেজেছে এক অপরূপ সাজে। বায়ু দূষণের কারণে যে ঢাকা শহরে প্রকৃতি ছিল নির্জীব, সেই প্রকৃতি আজ সেজেছে নবরূপে। প্রকৃতির এমন বিশুদ্ধতায় আনন্দিত বন্যপ্রাণীরাও। সম্প্রতি কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের নীল জলে উচ্ছ্বসিত খেলায় মত্ত ছিল ডলফিনের দল। বাতাসে হু হু করে কমছে দূষণ। পাহাড়েও বইছে সমীরণ, আকাশে নেই কার্বন, গাছে গাছে ফুটছে ফুল। প্রকৃতি যেন বহুকাল পরে আপন আলোয় ফিরেছে।
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, একটি জাতির মহত্ব ও নৈতিক অবস্থান নির্ধারিত হয়, সে জাতি প্রাণ-প্রকৃতিকে কীভাবে বিবেচনা করে বা কতটুকু ভালোবাসে তার উপর। করোনাকালীন মহাত্মাজীর কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। তিনি প্রায় শত বছর অগে এই প্রকৃতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলেও আমরা মানবজাতি কেন এতদিন পরেও প্রকৃতির গুরুত্ব যথাযথভাবে বুঝতে সক্ষম হইনি। আগামী পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ এক বার্তা নিয়ে প্রাণঘাতি সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে নভেল করোনাভাইরাস। তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মানব সভ্যতাকে নতুন করে উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে। প্রকৃতির সাথে প্রযুক্তির, বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের, দর্শনের সাথে সাহিত্যের, পারিপার্শ্বিকতার সাথে শিক্ষার, নগরায়নের সাথে গ্রামের সামঞ্জস্য বিধান করতে পারলেই হয়তবা এই সভ্যতা টিকে থাকবে। না হলে হয়ত আমাদের একইভাবে বারবার অজানা শত্রুর হাতে জীবন বিসর্জন দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।