আমাদের চর, চরের আমরা
:: মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন ও সত্যরঞ্জন সাহা ::
পাটগ্রামচর আশ্রয়কেন্দ্র কলোনীতে ১০০টি পরিবারের বসবাস। পদ্মা নদী থেকে আশ্রয়ন কেন্দ্র কলোনীর দুরত্ব ২ কিলোমিটার। পদ্মা নদীতে জ্যৈষ্ঠ মাসে পানি বাড়ার সাথে সাথে চর এলাকায় পুকুর খাল-বিলসহ চারিদিকে পানিতে ভর্তি থাকে। চর এলাকায় জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত গৃহস্থালি কাজে খাল বিলের পানি ব্যবহার করে। কিন্তু ভাদ্র থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত খাল, বিল ও পুকুরে পানি না থাকার কারণ হিসেবে এলাকার বাসিন্দারা জানান, এসব খাল, বিল ও পুকুর পদ্মা নদীর পানির নিচে চলে যাওয়া এবং এলাকাটি পলি মাটি হওয়ায় পানি থাকে না। তাই পানি সমস্যা সমাধানের জন্য এলাকাবাসীরা টিউবওয়েল ব্যবহার করেন। কিন্তু সমস্যাটি হলো, গবাদিপশু ও কৃষিকাজে পানির সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ এ সময় খাল, বিল ও পুকুরে পানি থাকে না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য এলাকাবাসীরা অনেকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি প্রতিনিধিদের নিকট দাবি জানিয়ে এসেছেন কিন্তু কোন সমাধান তারা পাননি। কী করবেন তারা? উপায়ন্তর না দেখে তারা নিজ উদ্যোগে ৬ বিঘার সরকারি পুকুরটি পুনঃখননের সিদ্ধান্ত নেন।
পুকুরটি পুনঃখননের জন্য এলাকাবাসীরা বিশেষ করে কৃষকসহ অন্যান্য পেশাজীবী মানুষেরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তারা কিভাবে এই পুকুরটি পুনঃখন করবেন সে বিষয়টি আলোচনার জন্য স্থানীয় কৃষক সংগঠনের সদস্য ও পাটগ্রাম আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসকারীরা মতবিনিময় করেন। মতবিনিময় সভাটি বারসিক’র সহায়তায় আয়োজন করা হয়। সভায় কৃষক ও অন্যান্য পেশাজীবীগণ জানান, অতীতে মানুষসহ গবাদিপশু গোসল ও গৃহস্থালির কাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানি এই পুকুর থেকে সংগ্রহ করা হতো। এছাড়া পুকুর পাড়ে সবজি চাষ, পুকুরে মাছচাষ করে ১০০টি পরিবার নিজেদের পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতো। কিন্তু পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ার পর এসব কর্মসূচি যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে তেমনিভাবে পানি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। মতবিনিমিয় সভায় তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, যেকোনভাবেই হোক পুকুরটি পুনঃখনন করতে হবে। এই প্রসঙ্গে পুকুরটি পুনঃখননের প্রক্রিয়া সম্পর্কে পাটগ্রাম আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত সমবায় সমিতির সভাপতি সিদ্দিক মোল্লা বলেন, “প্রতি পরিবার থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা ধরা পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং তাতে ১০০ পরিবার থেকে মোট ৩০ হাজার টাকা সংগৃহীত হবে। এছাড়া প্রতিটি পরিবার থেকে একজন সদস্য বাধ্যতামূলকভাবে পুকুর পুনঃখননের কাজে নিয়োজিত হবে।” তিনি আরও বলেন, “এ পুকুরটি পুনঃখনন করে পাড় বেঁধে দেওয়া হবে। সেখানে ফলদ গাছ এবং সবজি আবাদ করা হবে। পুকুরে মাছও চাষ করা হবে। এই পুকুরের জমির পরিমাণ দুই একর। তাই ৩০ হাজার টাকা দিয়ে হয়তো পুরো পুকুরটি খনন করা সম্ভব হবে না। আর্থিক সহায়তা পেলে এই পুকুটিরকে সম্পূর্ণ এবং আর গভীরভাবে খনন করা সম্ভব।” এই পুকুরের পুনঃখননকে কেন্দ্র করে অন্যান্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে এবং অন্যদের সহযোগিতা লাভের জন্য নানাভাবে প্রচারণার কাজ করা হয়।
এভাবে পাটগ্রাম আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর বাসিন্দারা পুকুরটি খননের জন্য বাড়িতে কোদাল, টুপরিসহ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে কাজে লেগে যায়। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ৩৫ জন মানুষ পুকুরটি পুনঃখননের কাজে জড়িত হয়। তারা টানা ১৫ দিন পুনঃখননের কাজ করে ৬ বিঘা পুকুরের ৫ ফিট গভীরতা তৈরি করেন। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পুকুর পুনঃখনন কার্যক্রমটি ইউনিয়ন পরিষদ, সুশীল সমাজ, উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন মহলের বেশ সাড়া পড়েছে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কিভাবে আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দারা বিশাল একটি পুকুর পুনঃখনন করে নিজেদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন সেটি জানার জন্য উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবুল বাশার সবুজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এলাকাবাসীদের সমন্বিত উদ্যোগ দেখে তিনি অভিভূত হন এবং আগামী ২০১৬ অর্থ বছরে পুকুরটি আরও গভীরভাবে খনন করার জন্য সরকারি বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা করেন। অন্যদিকে উপজেলা মৎস্য অফিস পুকুরে মাছ চাষের জন্য মাছের পোনা দেওয়ার আশ্বাস দেয় এবং পুকুরটির চারপাশে ফলদ ও সবজি আবাদের জন্য উপজেলা বন বিভাগ ১৫০টি ফলের চারা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ইচ্ছাশক্তি থাকলে এবং উদ্বুদ্ধ হলে যে কোন এলাকার মানুষই সমন্বিতভাবে নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করার ক্ষমতা রাখেন। এক্ষেত্রে তাদেরকে কেবল উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। বারসিক পাটগ্রাম আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর বাসিন্দাদের উদ্বুদ্ধ করে তাদেরকে দিয়েই একটি বিশাল পুকুর পুনঃখনন করতে সমর্থ হয়েছে। পাটগ্রাম আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর বাসিন্দাদের সফলতা নিশ্চয়ই অন্য এলাকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করবে!