আগুন রাঙা ফাগুন
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। বসন্তের আগমনী বার্তায় প্রকৃতি আজ সেজেছে নতুন রূপে। পত্র পল্লবে শিহরিত পুস্পকুঞ্জ। প্রকৃতির সুরভিত নবরূপের আগমনী বার্তায় বোঝা যায় আজ দুয়ারে ফাগুনের উপস্থিতি।
কোহিলাম “ওগো কবি অভিমান করেছ কি তাই? যদিও এসেছ তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।” কহিল সে পরম হেলায়- “বৃথা কেন? ফাগুন বেলায় ফুল কি ফোটেনি শাখে? পুষ্পরতি লভে নি কি ঋতুর রাজন? মাতবী কুড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করেনি সে অর্ঘ্য বিরচন?” সুফিয়া কামালের বসন্ত বন্দনার এক জনপ্রিয় বাণী। ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে প্রকৃতির নির্মল স্নিগ্ধতায় বাংলা ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুই মাস নিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত হাজির হয়। শীতের বিদায়ের সাথে সাথে প্রকৃতি নতুন রূপে সেজে উঠে। গাছে গাছে নতুন পাতা ফুল ও ফলে ভরে ওঠে।
পহেলা ফাগুন এলেই সবার মন গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিপরিচিত গান আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়..। এসময় গাছের ডালে রাঙা পলাশ ও শিমুল ফুলের দোলায় মন পুলকিত হয়ে যায় সকলের। মৃদু-মন্দ দক্ষিনা বাতাসে ফাগুনের শূভ্র বার্তা নিয়ে ফুটে ওঠে অশোক, হিমঝুরি, ইউক্যালিপটাস, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গাব, গামারী, ঘোড়ানিম, জংলীবাদাম, জ্যাকারান্ডা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই, পলাশ, পাখিফুল, পালাম, বুদ্ধনারিকেল, মনিমালা, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, পলাশ, শাল, শিমূল, স্বর্ণশিমূল, ক্যামেলিয়া সহ নানা জাতের ফুল।
শীতের আবরণ ছেড়ে প্রকৃতির নতুন রূপে সাজ জানান দেয় আগুন রাঙা ফাগুনের। বসন্তের এই আগমনে প্রকৃতির মাঝে আচমকা কোকিলের কুহু কুহু গান কানে এলেই বলতে ইচ্ছে করে ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। এসময় প্রকৃতির মাঝে দেখা যায় এক নির্মল সজীবতার আভাস। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণে নতুন প্রাণ ফিরে আসে। পত্রপল্লবে ছেয়ে গাছের শাখা প্রশাখা। ফুল ও ফলে ভরে ওঠে বৃক্ষরাজি। দেখা যায়, ফুলে ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জন। বাঙালির দোলা লাগা হৃদয়ে কখন ছেয়ে যায় ব্যাকুলতার ছাপ।
১৪০১ বঙ্গাদ্ধ থেকে বাংলাদেশে শুরু হওয়া বসন্ত উৎসব বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত হয়। বাঙালির প্রাণের এই বসন্ত উৎসব ঘিরে নানা ধরনের বর্ণিল আয়োজন চলে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসন্ত বরণ উপলক্ষে নানা আয়োজনে লাল হলুদের বাসন্তী রঙে প্রকৃতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে বসন্তের উচ্ছলতা ও নব উনমাদনায় মেতে ওঠে প্রতিটি বাঙালির প্রাণ। বসন্ত বাঙালির ঐতিহাসিক রাষ্টাভাষা আন্দোলনের শহীদদের পুষ্পিত রক্তের স্মৃতিময় বারতা। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন বা একুশের পলাশরাঙা সেই স্মৃতিমাখা দিনের সাথে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের সাথে যেন মিলেমিশে এক হয়ে আছে।
বসন্ত মানে পরিপূর্ণতার রূপ। বসন্ত মানে নতুনের কলেবর। বসন্ত ঋতুতে গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকায় সূর্যের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। কেননা এসময় পৃথিবী সুর্যের দিকে হেলে থাকে। পৃথিবীর অনেক স্থানে এই ঋতুতে গাছের পাতা নতুন গজায়, ফুল ফোটে, ফল ধরে। নতুন গাছের সৃষ্টি হয়। অনেক প্রাণের মিলন ঘটে। নতুন প্রাণের জন্ম হয়। আবার অনেক জায়গায় বৃষ্টি হয়। ফলে গাছপালা ফলে ফুলে ভরে ওঠে। প্রকৃতি এক নতুন সজীবতায় উজ্জীবিত হয়।
বসন্তে আজ প্রকৃতি নতুন রূপে সেজে উঠেছে। এসময় গাছে গাছে নতুন পাতা ফুল ও ফলে ভরে ওঠে। বাঙালি সত্ত্বায় নতুনের আগমনী বার্তায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায়। বসন্তে ফাগুন আসুক বৈচিত্র্যময় এ ধরার সকল প্রাণ ও প্রকৃতির মাঝে। নবরূপ নবরাগে ফাগুনের এই ফল্গু ধারায় সুরক্ষিত হোক সবুজ পৃথিবী।