বারসিক’র কাজে প্রশংসা করলেন দাতা সংস্থা ফোরাম সিভ’র প্রতিনিধি দল
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল বিশ্বাস
দাতা সংস্থা দি সোয়ালোজ ইন্ডিয়া বাংলাদেশ’র অর্থায়নে পরিচালিত এগ্রোইকোলোজি, ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড ফুড সোভারেন্টি প্রকল্পের অর্জিত ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করলেন সোয়ালোজ ব্যাকডোনার ফোরাম সিভ’র দুই প্রতিনিধি। গতকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি, দিনব্যাপী মাঠ পরিদর্শন শেষে পানহা সক (প্রোগ্রাম অফিসার, সোয়ালোজ প্রোগ্রাম) এবং ফু ডোমা লামা (প্রোগ্রাম অফিসার, সাউথ এশিয়া) বারসিক কর্তৃক পরিচালিত প্রকল্পের অর্জিত ফলাফলের প্রশংসায় বলেন, “প্রান্তিক জনগোষ্ঠির ক্ষমতায়ন এবং স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা সমৃদ্ধিতে এ প্রকল্প কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।” বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক মািনিকগঞ্জ টিমের সংশ্লিষ্ট কর্মীবৃন্দ এবং চলমান প্রকল্পের অংশগ্রহণকারীদের সহযোগিতায় পরিচালিত দিনব্যাপী মাঠ পরিদর্শন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন দি সোয়ালোজ ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ প্রোগ্রামের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শিউলি হক।
দিনব্যাপী মাঠ পরিদর্শন কার্যক্রমের প্রথমেই ছিলো কর্মীপর্যায়ে শিখন ও অভিজ্ঞতা বিনিময়মুলক আলোচনা সভা। সকাল ৯টায় বারসিক সিংগাইর রিসোর্স সেন্টারের চলমান সকল প্রকল্প স্টাফ, মানিকগঞ্জ বারসিক’র হিসাব ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা নিতাই চন্দ্র দাস, ফোরাম সিভ এবং দাতা সংস্থা দি সোয়ালোজের তিন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আলোচনার শুভারম্ভ হয়। শুরুতেই পরিচয় পর্বে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী তাদের স্ব স্ব দায় দায়িত্বের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করেন। পরিচয় পর্ব শেষে চলমান প্রকল্পের বাস্তবায়ন কর্মকৌশল এবং উল্লেখযোগ্য কিছু ফলাফলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন করেন বারসিক সিংগাইর রিসোর্স সেন্টারের কর্মসুচী সমন্বয়কারী শিমুল বিশ^াস।
মাঠ পরিদর্শনে যাওয়ার আগে পরিদর্শনকারী দল এগ্রোইকোলোজি প্রকল্প স্টাফদের কাছে চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ এবং উল্লেখযোগ্য শিখন বা পরিবর্তনগুলো জানার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন কৃষিবিদ মাসুদুর রহমান, বিউটি সরকার এবং শারমিন আক্তার। চলমান প্রকল্পের চ্যালেঞ্জগুলোতে উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে কৃষিতে কোম্পানির প্রলোভন, কৃষিতে রাসয়নিক উপকরণের নির্ভরশীলতা, বাজার নির্ভরশীল কৃষি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর্বনাইজেশন চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা সংকট তৈরি করছে। তাছাড়া কৃষিতে বাজার নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং মধ্যসত্বভোগির দৌরাত্বের কারণে ফসলের লাভজনক মূল্য না পাওয়ায় নতুন প্রজন্মর কৃষিকাজে সম্পৃক্ততা কমে যাওয়াকে চলমান প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশল হিসাবে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বলা হয় যে, বারসিক প্রকল্পাধিন এলাকায় জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে রাসয়নিকের কুফল বিষয়ে সচেতনতা তৈরি একই সাথে প্রকৃতিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনার উপর দক্ষতা তৈরি করে উক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি নিরসনে অভিযোজন কৌশল হিসাবে লোকায়ত জ্ঞান চর্চা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা তৈরির উপর গুরুত্ব আরোপ করে কাজ করছে।
বিগত দিনের কাজের উল্লেখযোগ্য ফলাফল উপস্থাপনায় বলা হয় কর্মএলাকায় প্রকল্পের আওতাধিন জনসংগঠনগুলোর সাংগঠনিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তারা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারছে। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ততা বেড়েছে। যেমন-জন সংগঠনের সদস্যদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সদস্য হিসাবে জয়লাভ, ইউনিয়ন স্ট্যান্ডিং কমিটি, বাজার কমিটি, স্কুল কমিটি, কমিউনিটি ক্লিনিকের সদস্য হিসাবে যুক্ত হওয়া। তাছাড়া কর্মএলাকার জনসংগঠনের সদস্যদের মধ্যে কৃষিতে রাসয়নিক উপকরণ ব্যবহারের মাত্রা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। কৃষক সদস্যগণ স্বচেষ্ট রয়েছেন বাজার নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগে। যেমন-যৌথ এবং ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় বীজ সংরক্ষণ ও পারস্পারিক বিনিময়, জলবায়ু সহনশীল জাত নির্বাচনে যৌথ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে জাত নির্বাচন। কর্মউদ্যোগের ফলাফলে আরো বলা হয় যে কর্ম এলাকায় নারী নেতৃত্বের উন্নয়ন হয়েছে। নারীদের আত্মকর্মসংস্থানে সম্পৃক্ততার মাত্রা বেড়েছে।
পরিদর্শনকারী দল মাঠ পর্যায়ে দুইটি জনসংগঠনের সাথে আলোচনা করেন এবং প্রকল্প স্টাফদের দেওয়া তথ্যের সাথে জনগোষ্ঠীর পরিবর্তন সরেজমিনে মেলানোর চেষ্টা করেন। সকাল ১০.৩০ বায়রা ইউনিয়নের নয়াবিাড়ি কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সাথে আলোচনা শুরু করেন পরিদর্শনকারী দল। শুরুতেই জানতে চাওয়া হয় বারসিক’র সহযোগিতায় জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এবং সামষ্টিকভাবে কি ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। উত্তরে জনসংগঠনের পক্ষথেকে বলা হয় যে, ব্যক্তিগত ভাবে পরিবেশবান্ধব তথা প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর কৃষি চর্চা বিষয়ে সদসগণের দক্ষতা বেড়েছে। যে কারণে অধিকাংশ বাড়িতে জৈব সারের খামার তৈরি, স্থানীয় বীজ সংরক্ষনের প্রবণতাসহ বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ এবং চাষীর সংখ্যা বেড়েছে। ফলে তাদের পারিবারিক আয় ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে তাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হওয়ায় যৌথ উদ্যোগ বাস্তবায়ন সহজতর হয়েছে। এ প্রসংগে উক্ত জনসংগঠনের সভাপতি ইমান আলী বলেন, “বারসিক এর সহযোগিতায় গ্রাম থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত চার স্তরে সমন্বয় কমিটি তৈরি করেছি। আমাদের সমস্যা সমাধানে এ সমন্বয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।” পরিদর্শনকারী দল জনসংগঠনের সদস্যদের সাথে আলোচনা ছাড়াও জনসংগঠনের সহসভাপতি ইব্রাহিম মিয়ার জৈব সার, জৈব বালাইশক, প্রায়োগিক গবেষণা প্লটের জন্য প্রস্তুতকৃত শুকনা বীজতলা, বৈচিত্র্যময় ফসলের প্রদর্শনী প্লট, সমন্বিত বালাইদমন, বীজ সংরক্ষণ প্রক্রিয়া এবং জনসংগঠনের সমন্বিত উদ্যোগে পরিচালিত বীজ ব্যাংক পরিদর্শন করেন। এ ছাড়াও তারা কৃষক ইব্রাহিম মিয়ার বৈচিত্র্যময় ঔষধি, ফলজ বৃক্ষ সংক্ষনের প্রসংশা করেন।
দুপুরের খাবারের পর পরিদর্শনকারী দল কর্মএলাকাধিন জামসা ইউনিয়নের গোলাই কালিগঙ্গা কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সাথে একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং উক্ত সংগঠনের নারী সদস্যদের আয়বর্ধনমুলক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। আলোচনার মাধ্যমে সংগঠনের সভাপতি সেলিনা বেগম বলেন, “আমার সংগঠনের ২০ নারী সেলাই কাজ এবং ২৪ জন নারী ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করে টাকা আয় করতে পারছেন। এ টাকা নারীরা নিজেদের ইচ্ছামত খরচ করতে পারছেন।” এ ছাড়া নারীদের নেতৃত্ব উন্নয়ন প্রসংগে তিনি বলেন, “আগে আমাদের কথা বলতে ভয় লাগতো। আর এখন কৃষি বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদে সরাসরি কথা বলতে পারি এবং আমাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরতে পারি। ফলে আগের চেয়ে সেবা পাওয়ার মাত্রা বেড়েছে।”
মাঠ পরিদর্শন শেষে পরিদর্শনকারী দল বারসিক সিংগাইর রিসোর্স সেন্টারের সকল প্রকল্প স্টাফদের সাথে মাঠ পরিদর্শনের প্রতিক্রিয়া ও অনুভুতি প্রকাশ করেন। পানহা সক বলেন, এত অল্প সময়ে আমাদের মাঠ পরিদর্শনে সহায়তা করার জন্য বারসিককে ধন্যবাদ জানাই। তাছাড়া মাঠের মানুষের উদ্যোগ এবং তাদের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে।” ফু ডোমা লামা বলেন, “মাঠের মানুষ যেভাবে কাজ করছে তাতে আমি অভিভুত।” বারসিক এর পক্ষ থেকে পরিদর্শনকারী দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর মধ্য দিয়ে দিনের কার্যক্রম শেষ হয়।