সাম্প্রতিক পোস্ট

বনশ্রী রাণীর পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চা

শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার সদর ইউনিয়নের কালমেঘা গ্রামের ৩৬ বছরের কৃষাণী বনশ্রী রানী মন্ডল। তিনি একজন দরিদ্র তবে কর্মঠ নারী। ছোটবেলা থেকে বাপ-মা-ঠাকুরদা-ঠাকুরমার কাছ থেকে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ফসল চাষ, বীজ সংরক্ষণ এবং পরিচর্যা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াপশুনার পর কালমেঘা গ্রামের পরিতোষ মন্ডলের সাথে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের পর থেকে দারিদ্র্যতার সাথে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়। স্বামীর জমি জমা বলতে ২ বিঘা জমি। সংসারে স্বামী, স্ত্রী, দুই সন্তান, শ্বশুর ও শ্বাশুড়ীসহ মোট ৬ জন সদস্য। ৬ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারে দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য বনশ্রী রাণীকে সংগ্রাম করতে হয়। সংসারের দারিদ্র্যতা সম্পর্কে বনশ্রী রাণী বলেন, “সংসারে নুন আন্তে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। আমার স্বামী একজন কাঠ মিস্ত্রি ও দিনমজুর। স্বামীর একার আয়ে কোন রকমে দিন আনা দিন খাওয়ার মতো সংসার চলতে থাকে।”
1
সংসারের চাকাকে সচল করার জন্য তিনি বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে শুরু করেন। তাঁর এ কাজের মধ্যে রয়েছে পাতার চাতর তৈরি, ধান রোপণ, ধান মাড়াই, বসতভিটায় সবজি চাষ ও পরিচর্যা। স্বামী ও স্ত্রী মিলে ১০ কাঠা বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ ও হাঁস- মুরগি ও ছাগল  পালন করতে শুরু শুরু করেন। তিনি বলেন, “ বসতভিটায় স্বামীর সহযোগিতায় মৌসুমভিত্তিক আলু, টমেটো, বীটকপি, মুলা, গাজর, লালশাক, পালংশাক, ওলকপি, পুইশাক, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, ঢেড়স, চালকুমড়া, উস্তে, শসা, ঝিঙা, তরুল, শিম, পেপে, কচুরমুখী, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ ও সরিসা ইত্যাদি সবজি চাষ করি।”  বৈচিত্র্যময় সবজি আবাদ করে বনশ্রী রাণী ধীরে ধীরে সংসারে সচ্ছলতা আনতে সক্ষম হন।

সবজি ও ধান চাষাবাদের মধ্যে থেকে একদিকে যেমন তাঁকে বাজার থেকে সবজি ও ধান কিনতে হয় না অন্যদিকে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার সংসারে বর্তমানে শুধুমাত্র তেল ও নুন ক্রয় করতে হয়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বছরে সবজি বিক্রি করে প্রায় ২০-২২ হাজার টাকা আয় করি।” সবজি চাষ করে বনশ্রী রাণী  কেবলমাত্র বাড়তি আয় ও পরিবারের সবজি চাহিদা পূরণ করেননি পাশাপাশি নানা ধরনের শাকসবজি গ্রহণে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। আগে তিনি ঘরের চালে, গাছের উপর, খৈ গাছের ডালপালা দিয়ে মাঁচা তৈরি করে সবজি চাষ করতেন। তবে ২০১৫ সালে বারসিক থেকে সহায়তা পেয়ে মাঁচা তৈরি সবজি আবাদ করতে শুরু করেন। এতে করে তিনি প্রচুর ফলন লাভ করেন, যা তাঁর দারিদ্র্যতাকে দূর করতে সহায়তা করেছে বলে তিনি জানান।
2
বৈচিত্র্যময় শাকসবজি ও ধানের চাষে বনশ্রী রাণী জৈ সার ব্যবহার করেন। হাঁস-মুরগি-ছাগলের বিষ্ঠা, বাড়ির ময়লা আবর্জনা, তরকারির খোসা, ছাইমাটি বাড়িতে গর্ত করে রেখে পচিয়ে কম্পোষ্ট তৈরি করেন। তিনি বলেন, “আমি জমিতে কোন রকমের রাসায়নিক সার ব্যবহার করি না। কারণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে জমির শক্তি কমে যাই, কিন্তু জৈব সার দিলে ঠিক থাকে।” পোকা দমনের জন্য তিনি চুলোর বাসি ছাই ব্যবহার করেন যাতে করে ছাইয়ের লোনা স্বাদ পেয়ে পোকাগুলো চলে যায়। এছাড়া কেরোসিন, গুল ও তামাক মিশিয়ে ¯েপ্র,  হাতবাছাই ও মাঝে মাঝে জল ম্যাসিনে করে পাতায় ছিটিয়ে দেন এবং পোকা লাগা পাতা কেটে ফেলে দেন। যেন পোকার আক্রমন কম হয় এভাবে নিজস্ব আলোকে পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করেন বনশ্রী রানী।

বনশ্রী রাণী বাজার থেকে বীজ কেনেন না। তিনি তাঁর সবজি ক্ষেত থেকে পোক্ত ও ভালো মানের শস্যগুলো রেখে দেন বীজের জন্য। যাতে পরের বছরে তিনি সেই বীজ ব্যবহার করতে পারেন। বীজ রাখার জন্য সবসময় ভালো, সতেজ, ও পুষ্ট দেখে গাছ নির্বাচন করেন তিনি। বীজের জন্য নির্বাচিত ফল গাছে ভালোভাবে পাকিয়ে নেন। সবজি বীজ রাখার ক্ষেত্রে ফল থেকে সমস্ত বীজ বের করে ৫/৭টি কড়া রোদে শুকিয়ে নিয়ে কাচের ও প্লাস্টিকের বোতল রেখে দেন এবং মাঝে মাঝে বের করে রৌদ্রে শুকিয়ে নেন।
বনশ্রী রাণী শাকসবজি আবাদের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালন করেন। বর্তমানে তাঁর ৮টি হাঁস, ১১টি মুরগি এবং একটি ছাগল আছে। হাঁস ও মুরগির ডিম বিক্রি করে মাসে তিনি ১৫০০-২০০০ টাকা আয় করেন। এসব কাজের পাশাপাশি তিনি সেলাইয়ের কাজও করেন। সেলাইয়ের কাজ থেকে মাসে তিনি একটি ভালো অংকের টাকা আয় করেন বলে তিনি জানান।

3
সংসারের সচ্ছলতা আনার জন্য বনশ্রী রাণী বলতে সব ধরনের অর্থনৈতিক কাজের সাথেই জড়িত। তাই তো পুকুরে কাঁকড়া চাষ করেন তিনি। এখাতেও তিনি বছরে প্রায় ১২০০০ টাকা এবং খেঁজুরের গুড় বিক্রি করে ৫০০০ টাকা আয় করেন। তাঁর এসব কাজ সম্পর্কে তিনি  বলেন, “আমরা যে দুই লাখ টাকা ঋণ ছিলাম তা পরিশোধের পথে। বন্ধকী জমিও ছাড়িয়ে নিয়েছি। এছাড়াও গরু ক্রয় করার জন্য ৪০০০ টাকা সঞ্চয় রেখিছি। আর এসকল সম্ভব হয়েছে আমার এ কৃষি কাজের উপর থেকে।”
পরিবেশবান্ধব কৃষি কাজে অবদান রাখায় এলাকায় বনশ্রী রাণীর পরিচিতি বাড়ছে, বাড়ছে তাঁর সামাজিক মর্যাদাও! বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শ্যামনগর উপজেলার ৪, ৫, ৬নং ওয়ার্ডের মহিলা সংরক্ষিত আসনের জন্য নির্বাচন করেন তিনি। তবে সেবার মাত্র ১৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। তিনি আশা করছেন, কোন একসময় তাঁর এ ইচ্ছাও পূরণ হবে।

পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চায় বনশ্রী রাণীর এ ভূমিকা আমাদের কৃষিঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রমাণ করেছেন ইচ্ছা ও উদ্যম থাকলে মানুষ তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পরিবেশবান্ধব উপায়েই কৃষি চর্চা করলে কোন কৃষাণ ও কৃষাণী খালি হাতে ফিরবেন না বলে তিনি মনে করেন।

happy wheels 2

Comments