ফিরে দেখা আইলার ৮ বছর : প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় নেই কোন উদ্যোগ!
সাতক্ষীরা থেকে মো. আসাদুজ্জামান
দেখতে দেখতে ভয়াল আইলার ৮ বছর পার হয়ে গেলেও সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকায় প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এদিকে সুন্দরবন তার আপন মহিমায় নিজের ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন বনবিভাগ ও সুন্দরবন নির্ভর জনগোষ্ঠী।
২০০৯ সালের ২৫ মে সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায় ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস আইলা। ভয়ংকর সেই আঘাতের কথা এখনও ভুলে যায়নি মানুষ। থামেনি স্বজনহারাদের কান্নাও। আইলার আঘাতে শুধু সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নে ৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছিল। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল বিস্তীর্ণ জনপদ। এরপর ধীরে ধীরে বেড়ি বাঁধ নির্মাণ হলে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরলেও ফেরেনি তাদের সুদিন।
ভয়াল সেই দিনের কথা মনে হলে ভয়ে শিউরে উঠছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। কঠিন সংগ্রাম করে টিকে থাকলেও তাদের এখনও হাহাকার কমেনি। বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন পাশ্ববর্তী এলাকা হলেও লবণাক্ততার কারণে এখানে গাছ পালা জন্মেনা। এছাড়া দূর্গত এলাকার শিশুরা এখনও ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। পুষ্টিহীনতায় বিশেষ করে আক্রান্ত শিশু ও নারীরা।
এখানে সবুজ শাক সবজি জন্মেনা। ফলে পুষ্টির অভাব সব পরিবারেই আছে কম বেশি। পাশাপাশি নারী ও বৃদ্ধরা চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় রোগাক্রান্ত মানুষ দুর্গম চর এলাকা থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে দুরে যেতেও পারছেন না। কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিক থাকলেও সেখানে চিকিৎসা সেবার মান উন্নত নয়। তাদের নেই খাবার পানি, চিকিৎসা ও ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা।
পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটেছে গাবুরা ও পদ্মপুকুরে। কোনো কৃষি খামারও নেই। ফলে মানুষ কৃষি কাজও করতে পারছে না। তবে কাঁকড়া চাষে প্রসার এসেছে। অল্প পুঁজি নিয়ে সামান্য জমিতে কাঁকড়া চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করবার সুযোগ পাচ্ছেন।
শ্যামনগরের গাবুরা গ্রামের আসাদুল ইসলাম জানান, “উপকুলীয় এলাকা লবণ পানির চিংড়ি চাষ ছাড়া আর কিছুই হয়না। সেই রকম গাছ পালা জন্মে না। আইলার বছর খানিক পর সরকারিভাবে বেড়িবাঁধগুলোতে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও সেটি সফল হতে পারেনি।”
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এসএম আতাউর রহমান বলেন, “এক সময় এই এলাকা গাছ-গাছালিতে ভরা ছিলো। এখন সেখানে খা খা করছে গাছপালাহীন পানি আর পানি। সবুজের বালাই নেই। নেই পরিবেশগত ভারসাম্য।” তিনি আরোও বলেন, “২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতের পর কিছু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হলেও এখনো অনেক পরিবারকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বেঁচে থাকার তাগিদে বহু পরিবার এলাকা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে গেছে। ঘর-বাড়ি হারিয়ে অসংখ্য পরিবার খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ ও মরিচ্চাপ নদীর বেড়িবাঁধের উপর বসবাস করছে এখনো। এসব পরিবারগুলো খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে।”
আইলার পর ৮ বছর অতিবাহিত হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলো পুরোপুরি সংস্কার না হওয়ায় এখনও ঝূঁকিতে রয়েছে এ জনপদের মানুষ। কিছু বাঁধ নিজেদের উদ্যোগে সংস্কার করা হলে সেটি পর্যপ্ত না।
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী আযম টিটো জানান, আইলার পর ৮বছর অতিবাহিত হলেও সেই ক্ষত আজ কাটিতে উঠতে পারেনি এই এলাকার মানুষ। এলাকায় ফসল উৎপাদন বন্ধ থাকায় কারও কোন আয় উপার্জন নেই। এলাকায় কোন কাজ না থাকায় বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। বিশেষ করে সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে এই অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ। বৃষ্টি ও পুকুরের পানিই তাদের একমাত্র ভরসা। জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসলি জমিতে ফসল হয়না দীর্ঘদিন। গাছপালাও হয়না তেমন, একটি গাছের জন্য অনেক টাকা খরচ করেও বাঁচানো যায় না।
এদিকে বনবিভাগ ও সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, আইলা’র ৪/৫ বছরের মধ্যেই ক্ষত কাটিয়ে উঠেছে বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। সুন্দরবনে গত ত্রিশ বছর কাটানো মুন্সিগঞ্জ গ্রামের আবুল কাশেম ও গাবুরা ইউনিয়নের ২নং সোরা গ্রামের মুনসুর আলীর মতো অনেকেরই দাবি স্বরূপে ফিরেছে সুন্দরবন। আইলায় পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের অনেক অংশ প্রলংকারী ঝড়ের তান্ডবে গাছ-গাছালি শুন্য হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ আট বছর পরে এসে সুন্দরবন পুরানো চেহারায় ফিরেছে বলে তাদের দাবি।
পদ্মপুকুরের শফিকুল ইসলাম ও মুন্সিগঞ্জ পিষুস বাউলিয়া পিন্টুর মতো অনেকেই জানান, আইলার ক্ষতি সুন্দরবন কাটিয়ে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক নিয়মে সুন্দরবন পুনর্গঠিত হয়েছে। কিন্তু আইলা’র পরবর্তী গত আট বছরে মানুষ সৃষ্ট অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ক্ষয় ক্ষতি আজও কাটিয়ে ওঠা না গেলেও মাত্র ৪/৫ বছরের মধ্যেই সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবে নিজ বনের অনেকাংশে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষমতা দেখিয়েছে। বনজীবীরা আরো জানান, বাঘ ছাড়া অপর সকল জীব-জন্তুর সমাগম প্রায় আগের অবস্থনে ফিরেছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাসেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, “২০০৯ সালে আইলার আঘাতে বিধস্ত সাতক্ষীরা উপকূলীয় শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সবকিছুরই উন্নতি হচ্ছে। কারণ সরকার উপদ্রুত এলাকার সামগ্রিক মান উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপই নিয়েছেন।”
এখানে ১৩২টি সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে। আরও ৫০ টি নির্মাণ হচ্ছে। কর্মসংস্থানের জন্য তাদেরকে কাঁকড়া চাষে আগ্রহী করে তোলা হয়েছে। পাড় উঁচু পুকুর খনন করে খাবার পানি সংকট এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই অঞ্চলে গাছগাছালি বাড়াতে সরকারিভাবে বিভিন্ন বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৬টি উপকূল এলাকার জন্য আলাদা বোর্ড করার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানালেন জেলা প্রশাসক।
সরকারি, বেসরকারি, প্রতষ্ঠিান এবং ব্যক্তি উদ্যোগ যতটা না অবকাঠামো কেন্দ্রিক। তার খুব স্বল্প পরিমাণই এলাকার প্রাণবৈচিত্র্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কোথাও আবার সেটিও দৃষ্টিগোচর হয় না। অবকাঠমো এবং প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়ার অসামঞ্জস্যতার কারণে এই এলাকার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তেমন কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। তাইতো সুন্দরবন তার সহমহিমায় ফিরলেও ফিরতে পারেনি গাবুরা, পদ্মপুকুর এবং প্রতাপনগর এর মতো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো।