আব্দুল মোতালেব এর পাখি পালন
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামে বাস করেন আব্দুল মোতালেব (৬৬)। দেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানান পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করেন কিন্তু কোন পেশাতেই তাঁর মন বসেনি। ওইসব পেশা ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি অফূরন্ত সময় পান। এর মধ্যে শখের বসে তিনি অনেক কিছুই করেছেন। এ শখ থেকে তিনি ২০১২ সালের শেষের দিকে এক জোড়া টার্কি নিয়ে আসেন পালন করার জন্য। ব্যস, অবশেষে পশু-পালনে তাঁর মন বসে। টার্কি পালন করে লাভবান হওয়ায় তার ‘শখ’ পেশায় রূপান্তরিত হলো। এভাবে টার্কির পাশাপাশি তিনি তিতির, কালিম, কবুতর, ভারতীয় ও পাকিস্তানি আসলী ফাইটার মুরগি পালন করতে শুরু করেন। টার্কি, তিতির, কবুতর, কালিম ও আসলী ফাইটার মুরগি পালনের মাধ্যমে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন “আমাদের দেশে অনেক শিক্ষিত যুবক-যুবতী রয়েছে যারা চাকরির আশায় থেকে কোন কিছু করে না। কিন্তু যদি তারা চাকরির প্রত্যাশার পাশাপাশি পশু পালন করে তাহলে তারা নিজেরাই নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেন বলে আমি মনে করি।” আব্দুল মোতালেব-এর পশু পালনটি থেকে কিছু ধারণা নেওয়া যাক;
টার্কি
টার্কি দিয়ে শুরু করেন পাখি পালন। ২০১২ সালে শেষের দিকে এক জোড়া টার্কি নিয়ে আসেন পালন করতে। সেই এক জোড়া টার্কি আজ হয়েছে অনেক জোড়া। এই ৩-৪ বছরে টার্কি বিক্রি করে আয় করেছেন প্রায় ৫ লক্ষ টাকার মতো। তিনি ৭৫ দিনের এক জোড়া টার্কি বাচ্চা বিক্রি করেন ৪ হাজার টাকায়। ৬ মাস বয়সী টার্কি বাচ্চা বিক্রি করেন ৬ হাজার টাকায়। একটি টার্কি বাচ্চা ৬ মাস বয়স হলে ডিম দেওয়া শুরু করে। একটি টার্কি ১৫-১৬টি ডিম দেওয়ার পর তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ টার্কি সর্বোচ্চ ১৮ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। একটি মা টার্কি প্রতি তিন মাস পর পর ডিম দিয়ে থাকে। টার্কি বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে। তিনি যে টার্কিটি পালন করছেন সেটি হল ময়ূরী জাত টার্কি।
তিতির
আব্দুল মোতালেব তিতির পালন করছেন প্রায় এক বছর হলো। এ পর্যন্ত তিনি ৬ জোড়া তিতির বিক্রি করেছেন ১৫ হাজার টাকায়। আড়াই মাসের প্রতি জোড়া তিতির বিক্রি করেছেন ২ হাজার ৫ শ’ টাকায়। তিতির তার বাড়িতে এখন পর্যন্ত ২০০-২৫০টি ডিম দিয়েছে। যার জন্য তিতিরের মা দিয়ে ডিম না ফুটিয়ে তিনি মুরগি দিয়ে ডিম ফোটান। তবে মুরগি দিয়ে ডিম ফুটিয়ে তেমন লাভ করতে পারছেন না আব্দুল মোতালেব। তাই ডিম ফোটানোর যন্ত্র কেনার কথা ভাবছেন। তার কাছে যে তিতিরগুলো আছে সেগুলো একেকটার ওজন দুই থেকে আড়াই কেজি ।
আসলী মুরগি (ফাইটার)
আব্দুল মোতালেব ভারতীয় ও পাকিস্তানি আসলী মুরগিও (ফাইটার) পালন করছেন। বর্তমানে দু’টি মুরগি ও দু’টি মোরগ রয়েছে তাঁর। ইতিমধ্যে একটি মুরগি ডিম দেওয়া শুরু করেছে। এবার খুব সাবধানতার সাথে পালন করছেন। কারণ আগেরবার পালন করতে গিয়ে অসাবধানতা বশে তিনি অনেকগুলো মুরগি হারিয়েছেন। তাই এবার তিনি খুব সতর্কতার সাথে এই মুরগি পালন করেন বলে জানান।
কবুতর
টার্কি, তিতির বা মুরগির পাশাপাশি আব্দুল মোতালেব কবুতরও পালন করছেন। বিগত ৬ মাস আগে তিনি কবুতর পালন করতে শুরু করেন বলে জানান। এই ছয় মাসে তিনি সংগ্রহ করেছেন মোট ২২ জাতের কবুতর। জাতগুলোর মধ্যে আছে রেসার, বাগদাদ গুমা, হিলমেট, সাদা রেসার, সিরাজী, মুক্ষিয়া, সোয়া চন্দন, গিরিবাজ, কাগজী, ময়ূরী অপরাজিতাসহ আরো ১২ প্রজাতির কবুতর। তিনি জানান, কবুতর বিক্রি করে তিনি প্রতিমাসে আয় করছেন ১২ হাজার টাকা।
কালিম
কালিম পালনেও হয়েছেন সফল আব্দুল মোতালের। বিগত এক বছর থেকে কালিম পালন করতে শুরু করেন। এই পর্যন্ত কালিম বিক্রি করে আয় করেছেন প্রায় ৫৮ হাজার টাকা। প্রতি কালিম জোড়া বিক্রি করেন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায়। বর্তমানে তার সংগ্রহে আছে দু’টি কালিম। এছাড়াও ১২টি কালিমের ডিম এখন মুরগি দিয়ে ফোটাচ্ছেন।
এসব পশু পালনে সুদক্ষ হতে হবে বলে জানান আব্দুল মোতালেব। কারণ এসব পাখি অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই এসব পাখির চিকিৎসার প্রাথমিক জ্ঞান থাকা জরুরি। আব্দুল মোতালেব হাঁস কিংবা মুরগির চিকিৎসা পদ্ধতির শিখেছেন আজ থেকে ৩০ বছর আগে একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়। বর্তমানে সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তিনি তার পালিত পাখির চিকিৎসা করছেন। টার্কি, তিতির, আসলী মুগরী, কবুতর ও কালিমের চিকিৎসা পদ্ধতি তিনি এই নিয়মে করে থাকেন। খুব বড় ধরনের রোগ হলে তিনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
অন্যদিকে এইসব পাখিদের খাবার সম্পর্কে সতর্ক হতে হয় বলে জানান আব্দুল মোতালেব। খাবার হিসেবে তিনি ওই পাখিদের ধান, গম, চাল, ভূট্টা দেন। এসব খাবার অনেক সময় বাজার থেকেই কিনতে হয় তাকে। তাই পাখি পালনে খাবার বাবদ তাঁর একটি খরচের খাত রয়েছে। আব্দুল মোতালেব প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই শ’ টাকা খরচ করেন পাখিদের খাবারের পেছনে।
আরেকটি মজার তথ্য হলো, আব্দুল মোতালেব টার্কি, তিতির, আসলী মুরগি (ফাইটার), কবুতর, কালিম পাখিগুলো সরাসরি বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন না। তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তিনি এসব পাখি বিক্রি করেন অনলাইনের মাধ্যমে। ফেইসবুক ও বিক্রয়ডট কম হল তাঁর বিক্রির মাধ্যম। ফেইসবুক ও বিক্রয়ডট কম এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন স্থানে এই পাখিগুলো বিক্রি করেন। বিক্রির করার এই সুন্দর সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি। আরও বড় আকারে ঘর করে ফার্ম করার চিন্ত করছেন তিনি। আশা করছেন আগামীতে একটি বড় ঘর করে সেখানে বাণিজ্যিকভাবে পাখি পালন করবেন।
আব্দুল মোতালেব এই বিভিন্ন প্রকার পাখপাখালী তিনি পালন করছেন শখের বসে। এভাবে তাঁর দিন কাটে এই পাখিদের যত্ন করে। তবে পাখি পালনের পাশাপাশি তিনি পুকুরে মাছ চাষ এবং বসতভিটায় রোপণ করেছেন বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু সহ আরো বিভিন্ন প্রকারের ফলের গাছ।
এভাবে ইচ্ছাশক্তি ও অক্লান্ত পরিশ্রম করে আব্দুল মোতালেব প্রমাণ করেছেন মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে।