বর্ষায় জেলেদের জীবনযাপন ও জ্বালানি ব্যবহার
মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম ও সুবির সরকার
কাচা মাটির বাঁধ মানের আষাঢ়-শ্রাবণে, প্রকৃতির ঘনঘটা ও জোয়ার ভাটার অমোঘ বিধান অনুযায়ী মৌসুমি জলবায়ুর দেশ হিসেবে আমাদের দেশে আষাঢ়-শ্রাবণে নিয়মিত বর্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক দশকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অনিয়মিত বর্ষা ও হঠাৎ বন্যা, খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি অনবরত মোকাবেলা করে টিকে আছে গ্রাম-বাংলার নিম্নবর্গে র মানুষ ও প্রান্তিক কৃষক ও জেলেরা।
আমাদের দেশ ভাটির দেশ হলেও বর্তমানে পরিবর্তিত অবস্থায় ভৌগলিকভাবে কয়েকটি উপসর্গ দেখা যায়। যেমন দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল লবণ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার অবস্থা বিরাজ করছে এবং উত্তারাঞ্চলে প্রচন্ড তাপদাহ ও খরায় ফসল এবং জীববৈচিত্রের ক্ষতি হচ্ছে। রাজধানীর আশেপাশে শহর রক্ষার নামে বিভিন্ন বেরিবাধ ও ড্রেজিং দিয়ে পুকুর, ডোবা, নালা ভরাটে তীব্র জলজট দেখা যাচ্ছে।
রাজধানীর নিকটবর্তী মানিকগঞ্চ জেলা তার বাইরে নয়। এখানে কৃষিক্ষেত্রে রয়েছে বৈচিত্র্য, রয়েছে জলাবদ্ধতা ও জলজটের সমস্যা। সাধারণত এই গ্রামটি জেলার অন্যান্য গ্রামের তুলনায় নিচু বিধায় এটিকে গাংডুবি বলা হয়। একসময় সারাবছর পানি থাকলেও এখন আর সে রকম নেই। তবে হঠাৎ বর্ষা ও বন্যার প্রস্তুতি রাখতে হয়। বর্ষার প্রস্তুরি অন্যতম হলো জ্বালানি সুরক্ষা।
জেলে পাড়ায় নারী ও পুর”ষেরা এখন বাছনা পাট নিতে ব্যস্ত। জেলে পাড়ার লক্ষ্মী রাণী রাজবংশী (৭০) বলেন, “আমরা বছরে একবার বাছনা পাট নেওয়ার সুযোগ পাই, সেটি ভালো পাটের মধ্যে যেগুলো ছোট সেগুলো কেটে জাগ দেওয়া হয়। আমরা সেগুলোর আঁশ ছাড়িয়ে কৃষকদেরকে দিয়ে দেই। আমরা শুধু খড়ি পাই তাতেই আমরা খুশি। কারণ এই খড়ি দিয়ে বাড়ির চারপাশে, রান্না ঘর ও সৌচাগারে বেড়া দেই।” তিনি আরও বলেন, “সবচেযে বড় উপকার হলো সারাবছর প্রথমেই খড়ি দিয়ে জ্বাল ধরাতে হয় তাতে সারা বছরের জ্বালানি হয়। যারা এই কাজ করেন না তারা আমাদের কাছ থেকে খড়ি কিনে নেয় প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। এতে আমরা কিছু টাক্ াপাই এবং আমাদের তো আর কিনতে হয়না এতে সংসারে উন্নতি হয়।”
অন্যদিকে বিমলা রাজবংশী বলেন, “আমরা এখন জ্বালানি সাশ্রয় করার জন্য শিকের চুলা ব্যবহার করি। এতে গোবর দিয়ে গোবর লাঠি ও খসি ব্যবহার করা যায়। জ্বালানি কম ব্যয় হয় এবং ধোয়া কম লাগে।” জেলে পেশায় যাদের জীবন তাদের অধিকাংশ সময় নৌকার মধ্যে থাকতে হয় এবং নৌকার মধ্যে রান্না বান্না হয়। এই প্রসঙ্গে নেধুরাম মাঝি বলেন, “ঘরের গিন্নিরা যেমন রান্না বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে আমরাও মাছ ধরার জন্য নৌকা, জাল, বেসাল,বাঁশ ইত্যদি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বিশেষ করে বর্ষা মাসে জাল পানিতে বেশি থাকে তাই মজবুত করার জন্য গাব দিতে হয়। নৌকায় আলকাতরা দিতে হয়। গাছে গাছে গাবের সন্ধানে ঘুরি।” তিনি আরও বলেন, “এখন আগের মতো গাব পাওয়া যায় না, গাব গাছ নেই, মানুষ শুধু কাঠ বাগান নিয়ে ব্যস্ত আছে। আমার জায়গা থাকলে আমি গাবের বাগান করতাম। কারণ গাব আমার বন্ধু। এটি জাল শক্ত করে আবার ছোবরা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।” তিনি বলেন, “নদীতে সারাবছর পানি থাকে না বিধায় পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করি। আমাদের পেশাকে বাঁচাতে হলে প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর থাকতে হবে যাতে মায়েরা পর্যাপ্ত জ্বালানি পায়। এছাড়া সারাবছর নদীতে পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সারাবছর প্রাকৃতিক মাছ পাওয়া যায়।