শিল পাটা ধার কাটিয়ে চলছে ওদের জীবন

শিল পাটা ধার কাটিয়ে চলছে ওদের জীবন

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

শিল-পাটা নামক দু’টি পাথরের খন্ড মসলা পেষার কাজে ব্যবহৃত হয়। গ্রামীণ ও শহুরে জনজীবনে এর প্রভাব কমলেও প্রয়োজন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। গ্রাম অথবা শহরের অনেকেই বর্তমান সময়ে মসলা যান্ত্রিক মিলে পিষে থাকেন অথবা বাজার থেকে কেনা প্যাকেটজাত গুড়ো মসলা খাবার তৈরিতে ব্যবহার করেন। তদুপরি এক শ্রেণীর মানুষ যারা এখনো শিল পাটা ব্যবহার করেন তারা শিল পাটা ধার কাটানোর জন্য এ পেশাজীবীদের উপর নির্ভর করেন। তাই তো সীমিত আকারে হলেও শিল পাটা ধার কাটানো পেশাজীবীদের এখনো চোখে পরে রাস্তা ঘাটে। শীল পাটা ধার কাটিয়ে চলে তাদের জীবন।

sil pata pic-1
পাবনার চাটমোহরের নিমাইচড়া ইউনিয়নের শীতলাই গ্রামের জিন্নাত আলীর বয়স প্রায় ৬৬ বছর। পিতার নাম ইফসুফ আলী। অভাবের সংসার হলেও বই খাতা নিয়ে পড়ালেখা হৈ হুল্লোর ছুটো ছুটিতে ব্যস্ত ছিলেন। তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র তিনি। এখন থেকে ৫৬ বছর আগের কথা। হঠাৎ পিতার মৃত্যু হলে সংসারের বড় ছেলে হিসেবে সংসার পরিচালনার সমস্ত দায় দায়িত্ব চাপে তার কাঁধে। মাত্র ১০ বছর বয়সে শুরু করতে হয় জীবন যুদ্ধ। হাতে তুলে নেন তালা চাবি সাড়ার ছোট্ট টিনের বাক্স। কিছুদিন পর শুরু করেন শিল পাটা ধার কাটানোর কাজ। এখনো নিয়োজিত আছেন এ কাজে।

sil pata pic-2

জিন্নাত আলী বলেন, “বাবার মৃত্যুর পর বিধবা দাদী, বিধবা মা, দুই ভাই, দুই বোন ও আমিসহ পরিবারের খানে আলা তখন ৭ জন। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে এদের মুখের ভাত ও পরনের কাপর চোপরসহ সব কিছুর দায় দায়িত্ব চলে আসে আমার উপর। যুদ্ধ সেই যে শুরু। এখন ও শেষ হয়নি। হয়তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “শিল পাটা ধার কাটিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজে বিয়ে করি, দুই বোন দুই ভাইকে বিয়ে দেই। তাদের এখন পৃথক সংসার। আমার দুই ছেলে। বড় ছেলে সেলুনের কাজ করে। ছোট ছেলে একটি অটো রাইসমিলে কাজ করে। তাদের ও পৃথক সংসার। এখন বেশির ভাগ সময় পাবনার টেবুনিয়া ও এর আশ পাশের এলাকায় শিল পাটা ধার কাটানোর কাজ করি। যখন যেখানে সূযোগ হয় সেখানেই থেকে যাই। সাংসারিক প্রয়োজন হলে বিকাশে টাকা পাঠাই। মাস খানেক পর পর বাড়িতে যাই। ১০ কাঠা বসত বাড়ি আছে। পরে ১৫ কাঠা মাঠাল জমি কিনেছি। দৈনিক দেড়শ থেকে দুইশ টাকা আয় হয়। এ টাকায় কোনমতে দিন পার করছি।”

sil pata pic-3
শামসুল হকের বয়স ৬৫ বছর। পিতার নাম পরশ উল্লাহ। বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলার বাহাদুর পুর গ্রামে। ২৬ বছর যাবত শিলপাটা ধার কাটানোর কাজ করে আসছেন। প্রতিদিন সকাল হলেই বেরিয়ে পরেন রাস্তায়। জীবন জীবিকার তাগিদে তাকে প্রতিদিন অন্তত কয়েক কিলোমিটার পথ হাটতে হয়। না হেটে উপায় তো নেই। জীবন চালানোর জন্য খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান রোগে ব্যাধিতে চিকিৎসা এ প্রয়োজনগুলো তো মেটাতে হয়। পানি ব্যতীত নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য কিনতে হয় তাকে। তাই শীত রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে শীল পাটা ধার কাটানোর কাজ করেন তিনি।

শামসুল হক বলেন, “স্কুলে পড়ালেখার সুযোগ হয় নাই কোনো সময়। আব্বা আছিল গরিব মানুষ। পড়াবি ক্যাবা কর‌্যা। হাজাম (খতনা) লেওয়ার আগেই মাসে ৫ টাকা বেতনে দাঁথিয়া গায়ের আবেদ মোল্লার বাড়ি হ্যাল্যা (গৃহস্থালী কাজ কর্ম করার লোক) থাকা শুরু করি। তখন ইংলিশ প্যান আছিল না। রবাট আলা হাফ প্যান পরি। একটানা ১৪ বছর হ্যাল্যা থাকি। শেষ বছর বেতন হইছিল ৩০০ ট্যাকা। ১৪ বছর হ্যাল্যা গিরি করার পর বিয়ে করি। মাসে ৩০০ ট্যাকা বেতনে চলা কঠিন হয়া পরছিল। তাই বিয়্যার পর শিল পাটা ধার কাটানোর কাম শুরু করি। সেই যে শুরু হলো আজও সেই কামই করছি।”

কিছুক্ষণ থেমে তিনি আরো বলেন, “জমা জমি করব্যার পারি নাই। ৭ শতক বাড়ি আছে। ৬ মিয়্যা এক ছাওয়াল আমার। ৫ মিয়্যাক বিয়্যা দিছি। ১৯৮৮ সাল থেকে গ্রামীণ ব্যাংক সমিতিত ভর্তি আছি। মিয়্যা গারে বিয়্যা দেওয়ার সময় ঋণ তুলি। ৫ মিয়্যাক বিয়্যা দিতি দেড় লাখ ট্যাকা লাগিছে। বছর ভর‌্যা কিস্তি দিয়া ঋণের ট্যাকা শোধ করি। ছোট মিয়্যা টিনা কুবিরদিয়ার মাদ্রাসায় নাইনে পড়ে। ছাওয়ালডা বিয়্যা কর‌্যা বউ লিয়্যা ঢাকা থাকে। গার্মেন্টে কাম করে। আলাদা সংসার তার। ছোট মিয়্যা আর আমরা স্বামী স্ত্রী দুইজন। মোট ৩ জন খানে আলা। বিবাহিত মিয়্যারাও জামাইসহ বেড়াবার আসে।” তিনি বলেন, “শিল পাটা ধার কাটায়া দিন ১শ’ ৫০ ট্যাকা থেকে ২শ’ টাকা আয় করি। গড়ে দৈনিক সংসার খরচ ও দেড়শ থেকে দুইশ ট্যাকা। বিপদে আপদে মানষির কাছ থেক্যা ধার দেনা করা লাগে। কোরবানীর ঈদির সময় কাম বেশি হয়। কেউ কেউ মোবাইল কর‌্যা ডাকে শিলপাটা ধার কাটানের জন্যি। নতুন শিল পাটা ৬০, পুরোনাগুলো ৪০ আর ছোট গুলো ৩০ ট্যাকায় ধার কাটাই। এই সব মিল্যা কোন রকমে দিন চল্যা যাচ্ছে।”

happy wheels 2

Comments