সাম্প্রতিক পোস্ট

পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কচু শাকের যোগানদাতা মেছের শাহ্ ভুগছেন অপুষ্টিতে

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

“দুই সের চাল হলি দুই দিন যায়। আর এক সের চাল রাধলী যায় দুই বেলা। সকালে মুড়ি টুড়ি যা হয় তাই খাই। দুপুর আর রাতি পেট ভর‌্যা ভাত খাই। তিরিশ টেকার কম মাছ হয় না। ঈদির মদ্যি গোস্ত খাইছিল্যাম। সমাজের ভাগে পাইছিল্যাম। সব সময় মাছ কিনব্যার পারি না। পয়সা লাগে। বড় মাছের দাম বেশি। কিন্যা খাব্যার পারি না। মেলা দিন পর কাল আধ স্যার দুধ কিনছিলাম”। সম্প্রতি কথাগুলো বলেছিলেন পাবনার চাটমোহর উপজেলা পরিষদের পূর্বে অবস্থিত ছোট শালিখা মহল্লার বাসিন্দা মেছের শাহ্।

চাটমোহরের অতি পরিচিত মুখ এই মেছের শাহ্। বয়স আশি বছরের মতো। দুই শতক জায়গার উপর দুইটি টিনের ছাপরার মালিক তিনি। একটিতে স্ত্রী শেফালী খাতুনকে নিয়ে বসবাস করেন। অন্যটিতে ছেলে মেয়ে বা আত্মীয় স্বজন আসলে থাকতে দেন। অন্য কোন জায়গা জমি নাই। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁচি হাতে বেড়িয়ে পরেন কচু শাকের সন্ধানে। রাস্তার পাশে, মানুষের বাড়ির আনাচে কানাচে, পতিত জমিতে, উঁচু ভিটা, বাগান বিভিন্ন জায়গায় কচুর শাক কাটেন। নয়টা নাগাদ বাড়ি ফিরে এসে কচুর শাক আটি বেঁধে বেড়িয়ে পড়েন বিক্রি করতে। আটির আকার আকৃতি ভেদে প্রতি আটি কচুর শাক দশ টাকা থেকে বিশ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। দুপুরের মধ্যে বেচা শেষ হয়ে যায়। দিনে চার পাঁচ আটি কচুর শাক বিক্রি করে ৭০ থেকে ৮০ টাকা আয় করেন তিনি।

kochu sak -1

চাটমোহরের অলিতে গলিতে দেখা মেলে তাঁর। মাথায় কখনো কচুর শাক, কখনো কলার ভাদাল, কখনো খানমান পাতা, কখনো কলার থোর অথবা কচুর লতি। শূভ্র চুল দাড়ির অধিকারী অভাবী এ ফর্সা মানুষটি যখন মায়াবী চোখে কারো কাছে তার সংগৃহীত শাক সবজি নিয়ে হাজির হন মানবিক কারণেই অনেকে তাকে ফেরান না। রাস্তা ঘাটে; মানুষের দড়জায় দরজায় কড়া নেড়ে জানতে চান কচুর শাক লাগবে কিনা। অনেকে বিরক্ত হন। অনেকে আবার উপাদেয় জনপ্রিয় ও সস্তা শাক সবজিগুলো হাতের নাগালে পেয়ে খুশি হন। অনেকে শাক সবজির বিনিময়ে চাল ডাল দেন মেছের শাহকে। মেছের শাহ্ কাঁধের পুটলীতে সেগুলো শক্ত করে বেঁধে রওনা হন অন্য দুয়ারে।

কত বছর যাবত শাক সবজি বিক্রি করেন এমন প্রশ্নের জবাবে স্মৃতি হাতরান মেছের আলী। হয়তো ফিরে যান অতীতে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “আমারে বাড়িত ঘানি আছিল। বাপ ত্যালের ব্যবসা করতো। কারেন্টের মিল আসলি গরুর গাছের ঘানি ভাঙাতে আর কেউ আসলো না। ঘানি বন্দ হয়া গেলো। বাপের সাথে কাম করিছি আগে। পরে হল্যাম রাজমিস্ত্রীর জোগান দার। শরীলির তেজ কুম্যা গ্যাছে। এখন কাম করব্যার পারি না। তাই আর কেউ ডাকে না। দুই মিয়্যা তিন ছাওয়াল। সগলেই বিয়ে করছে। যে যার মতো কামাই করে খায়। মিয়্যারা শ^শুর বাড়ি থাকে।” তিনি আরও বলেন, “ছাওয়ালরা বিয়া কর‌্যা চামটা গায়ে (গ্রামে) থাকে। মাঝে মদ্যি বাড়িত আসে। ছাওয়াল পাল থাক্যা কি? কেউ দ্যাখে না। বাপের ধার ধারে না কেউ। আমারে বুড়া বুড়ির তো প্যাটের ভাত কাপুর চুপুর ওষুধ পত্তর লাগে। কে দিবি? বস্যা থাকলি তো আর কেউ খাব্যার দেয় না। তাই কয়াক বছর হলো এতোর ওতোর থেক্যা শাক সবজি তুল্যা বেচি। চৈত বৈশাখ মাসে খানমান বেচি। যখন খাওয়ার মতো যা পাই তাই তুল্যা বেচি। মানুষ খাতক হয়্যা গ্যাছে। যা পায় তাই খায়। কোকনের হোটেল আর ওসমানের হোটেলে কচুর শাক বেশি টানে”।

kochu sak 6

মেছের শাহ বলেন, “কলার থোর এখন আর মানুষ দেয় না। কলা কাটার পর গাছের মালিকরাই থোর কাট্যা খায়। বানের পানি চারতোরে ছড়ায়া পরছিল। পানির কচুর পাতা খালি গলা ধরে। মানুষ গাল পারে। তাই পানির মদ্যিকার তা তুলি না। কয় দিন পর শীত পরবি। ঠান্ডার সময় মানুষ কচুর শাক খাব্যার চায় না। এতোরকর মানুষ নিজিরাই তুল্যা খায়। দুই একজন ব্যাচেও। সায়েবরা তুলব্যার পারেনা। তারা কচুর শাক কিন্যা ইলশা মাছ দিয়া ঘ্যাটা খায়”।

মানুষের দোড়গোঁড়ায় পুষ্টির যোগানদাতা মেছের শাহ্ বয়সের ভারে যেন নুয়ে পড়েছেন। রোগ ব্যাধিতে মেলেনা ওষুধ পথ্য। যিনি পেটে ভাতে খাওয়ার চিন্তায়, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের পুষ্টির যোগান দিচ্ছেন তিনি নিজেই ভূগছেন পুষ্টিহীনতায়। পুষ্টিকর খাদ্য; সুষম খাদ্যের ধারণা নেই তার। আর ধারণা থাকলেই বা কি! ভালো মাছ, মাংস, দুধ, ডিম খাবার মতো সামর্থ্য নেই তাঁর। তিনি বলেন, “চোখ দিয়্যা পানি পরে। ট্যাকার অভাবে ডাক্তার দেখাব্যার পারত্যাছি না। বিকালে সন্দায় চেনা পরিচিত মানুষির কছে যায়া চালি দুই চার ট্যাকা দ্যায়। এই দিয়্যা কি দিন চলে কন”?

kochu sak 5

এ সম্পর্কে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ভারতীয় দীপপুঞ্জ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কন্দ জাতীয় সবজি কচুর উৎপত্তি বলে অনুমান করা হয়। আয়ুর্বেদীয় গুন সম্পন্ন কচুর মূল, লতি, পাতা ডাটা মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কচুর শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন থাকে। এটি রাতকানা রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। আঁশ থাকায় পরিপাকতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। রক্ত শূন্যতা দূরীকরণ, কোষ্টকাঠিন্য দূরীকরণ ও হজমে সহায়তা করে কচুশাক। এর উদ্ভিজ্জ প্রোটিন দেহের কোষ গঠন ও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। আয়রন সমৃদ্ধ কচু শাক শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখে। শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখতে ভূমিকা রাখে। তিনি আরো জানান, কচু শাকের সাথে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত হলেও অবহেলা করে অনেকে সহজলভ্য এ শাক খাই না। অধিকতর কালো কচু শাকের গুনাগুন বেশি। প্রতি একশ গ্রাম কচুর শাকে ৩৯ গ্রাম প্রোটিন, ৬.৮ গ্রাম শর্করা, ১৫ গ্রাম চর্বি, ২২৭ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম, ১০ মিলিগ্রাম আয়রন, ৫৬ মিলিগ্রাম খাদ্য শক্তি থাকে। এটি আমাশয় রোগে ও বিশেষ উপকারী। আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও রোগ প্রতিরোধে কচু শাকের অবদান অপরিসীম।

happy wheels 2

Comments