নারীরা পারিবারিক আয়ে ভূমিকা রাখেন
সাতক্ষীরা থেকে ফজলুল হক
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্বকালীনগর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা কোহিনুর বেগম (৫০)। স্বামী মৃত মিজানুর গাজী। পেশায় ছিলেন একজন বনজীবী। স্বামীর কোন জায়গা জমি ছিল না। সুন্দরবনের মাছ,কাঁকড়া ধরেই চলতো তাদের সংসার। কোহিনুর বেগমের একজন ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। খুব সুখে শান্তিতে চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সুন্দরবনে মাছ, কাঁকড়া ধরতে গিয়ে ভয় পেয়ে আনুমানিক ২০০৯ সালে মারা যান মিজানুর গাজী।
স্বামী মিজানুর গাজী যখন মারা যান (কোহিনুর বেগমের ভাষ্য মতে) তখন ছেলে বিল্লাল হোসেনের বয়স ছিলো ৯ বছর আর মেয়ে মনিরা খাতুনের বয়স ছিলো ৭ বছর। ঠিক তখনই নেমে আসে কোহিনূর বেগমের পরিবারে দুঃখ কষ্ট। একদিকে পরিবারের খরচ অন্যদিকে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। তাই বাধ্য হয়ে তিনি জোন মজুরের কাজ ও নদীতে মাছ ধরা শুরু করেন। কিন্তু নদীতে মাছ ধরা ও জোন মজুরি দিয়েও যেন সংসার চলে না কোহিনুর বেগমের। সংসারে অভাব ও বোনটির কথা চিন্তা করে পরবর্তীতে ছেলে বিল্লাল হোসেন ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার পরে তাকেও কাজের সন্ধানে বের হতে হয় মায়ের সাথে। মা ও ছেলে দু’জনে খুব কষ্ট করে কিছু টাকা ম্যানেজ করে মেয়ে মনিরা খাতুনকে বিয়ে দেন। অন্যদিকে কোহিনুর বেগমের বয়স বাড়তে থাকায় আগের মত আর নদীতে মাছ ধরা ও জোন মজুরি দেওয়ার কাজ করতে পারেন না। খুব অভাব অনটনের মধ্যে চলতো সংসার।
গত আগস্ট ২০২১ সালে বারসিকের বাস্তবায়নে নেটজ পার্টনারশিপ ফর ডেভেলপমেন্ট জাস্টিস এর সহাযোগিতায় বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ (পরিবেশ) প্রকল্পের কাজ শুধু হয় মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে। পরবর্তীতে এলাকা সোশ্যাল ম্যাপিং করার মাধ্যমে জনগোষ্ঠীকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় (ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, হতদরিদ্র)। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বিধবা কোহিনুর বেগমের পরিবারকে হতদরিদ্রের তালিকায় চিহ্নিত করে।
এক পর্যায়ে কোহিনুর বেগম পূর্বকালীনগর হেতাল সিএসও দলের সদস্য হয়। তিনি হেতাল সিএসও দলের সদস্য হওয়ার পরে সর্ব প্রথম জলবায়ু সহনশীল কৃষি চর্”া বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং নিয়মিত সাপ্তাহিক গ্রুপে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও নিয়মিত দলীয় আলোচনায় পরবর্তীতে তিনি ছাগল ও হাঁস, মুরগি পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি যাতে সেই কাজ ভালোমত করতে পারেন সেজন্য প্রকল্প থেকে তাকে উপকরণ হিসাবে তিনটি ছাগল, পাঁচটি হাঁস ও পাঁচটি মুরগি, বীজ ও গাছের চারা দেওয়া হয়।
সহযোগিতা পাওয়ার নিয়মিত যতœ ও পরিচর্যায় কোহিনুর বেগমের এখন ছয়টি ছাগল এবং আটটি হাঁস ও দশটি মুরগির মালিক। কিছু দিন পূর্বে একটি ছাগল বিক্রয় করে একটি সেলাই মেশিন কেনার জন্য। তবে সেলাই মেশিনের দাম বেশি হওয়ায় সেই টাকা জমা করে রেখে দিয়েছেন। বাকি টাকা জোগাড় করে সেলাই মেশিন ক্রয় করবেন বলে তিনি জানান।
কোহিনুর বেগম বলেন, “নারীরা চেষ্টা করলে পরিবারে আয়ে ভূমিকা রাখতে পারেন। অনেকেই সেটা পেরে ওঠে না পুঁজির অভাবে। আর আমার কিছু করার জন্য বারসিক যে পুঁজিটা দিয়েছে,সেই পুঁজি দিয়ে এখন আমার আয় আসে প্রতিনিয়ত। কখনো ছাগল বিক্রয় করে কখনো হাঁস-মুরগিসহ ডিম বিক্রয় করে। অন্যদিকে পরিবারে খাওয়ার চাহিদাও মিটে যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘ছেলের বউ সেলাই মেশিনের কাজ জানে, তাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দিতে পারলে আরো আয় হবে পারিবারে। ছেলের আয়ের পাশাপাশি আমরা যদি কিছু আয় করতে পারি, তাহলে আমরা সকলে মিলে ভালো থাকতে পারবো।”