দূর্গা রানীর নরম কাঁকড়ার খামার

সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল

উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পরিবেশে নরম কাঁকড়া চাষে সফলতার মুখ দেখেছেন নারী উদ্যোক্তা দূর্গা রানী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বদলে যাচ্ছে পরিবেশ, বদলে যাচ্ছে প্রতিবেশ। দেশের উপকুলীয় এলাকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে টিকে থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন উপকুলীয় এলাকার পেশাজীবী জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পোড়াকাটলা গ্রামের দূর্গা রানী (৩৬) তেমনই একটি কৃষিজীবী পরিবার। স্বামী, শ^শুর, শ^াশড়ি ও এক সন্তান সহ ৫ সদস্যের ছোট্ট সংসার তার। স্বামী সঞ্জয় হালদার (৪৬) পেশায় দিনমজুর। বৃদ্ধ শ^শুর শ^াশুড়ীকে নিয়ে স্বামী ও স্ত্রী খুব কষ্ট করে ও দিনরাত পরিশ্রম করে একমাত্র ছেলেকে খুলনা সুন্দরবন কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি করিয়েছেন। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পরিবেশে মাত্র ১৭ শতক জায়গায় গড়ে তুলেছেন নরম কাঁকড়া চাষের খামার। নিজের অদম্য সাহস ও আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে খামারের মাধ্যমে লাভের মুখ দেখেছেন তিনি।

২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশিপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় বারসিক’র বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পোড়াকাটলা গ্রামে গাংচিল সিএসও দলে যুক্ত হয় দূর্গা রানী। যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক দলীয় আলোচনায় সভায় অংশগ্রহণ করেন। দলে যুক্ত হওয়ার কিছুদিন পরে বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে তার পারিবারিক ও ব্যবসায়িক উন্নয়ন পরিকল্পণা গ্রহণ করা হয়। যার পে্িরক্ষতে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসেবে নরম কাঁকড়া চাষে (কাঁকড়া) উপকরণ সহযোগিতা করা হয়। পরিবেশ প্রকল্প থেকে তাকে একই সাথে একটি কদবেল ও সবেদার চারা, কিছু বর্ষাকালীন বীজ ও দুটি হাঁস সহযোগিতা দেওয়া হয়। এরপর বারসিক এর নিয়মিত আলোচনা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় তিনি কাঁকড়া চাষে সফলতার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। দূর্গা রানী জানান, “আমার শ^শুরের ১৫ শতক লবণ পানির একটি পুকুর ছিল, সেখানে আগে থেকেই আমার নরম কাঁকড়ার হ্যাচারী ছিল। ভালোভাবে চালাতে পারছিলাম না। একটা চালান মার খাওয়ার পর আর কাঁকড়া ছাড়ার মত অবস্থানে ছিলাম না। ঠিক তখনই বারসিক এর সাথে পরিচয় হয়। তখনই দলীয় আলোচনার মাধ্যমে বারসিক থেকে আমার ইচ্ছে পূরণের সুযোগ ঘটে। আমি বারসিক থেকে শক্ত কাঁকড়া সহযোগিতা নিয়ে ব্যবসাটি আবোরো ভালোভাবে শুরু করি।”

প্রথমদিকে তার এ কাজে একটু সমস্যা হলেও এখন আর সমস্যা খুব বেশি হয়না। পুরোপুরি শিখে ফেলেছেন ব্যবসার হালচাল। নিজের সার্বক্ষণিক পরিচর্যার মাধ্যমে ১৫ শতক জায়গা (হারি) লীজ নিয়ে চলমান রেখেছেন নরম কাঁকড়া উৎপাদন খামার। তার খামারে রয়েছে ১০০০টি বক্স। তিনি স্থানীয় বাজার ও ব্যবসায়ীর নিকট থেকে শক্ত কাঁকড়া সংগ্রহ করেন। সেগুলো বক্সের মাধ্যমে ছেড়ে সেখান থেকে নরম কাঁকড়া সংগ্রহ করেন। প্রতিদিন ৬বার (৪ ঘন্টা পর পর) চেক দিতে হয়। খাবার হিসেবে তিনি তেলাপিয়া মাছ কেটে দেন প্রতিটি বক্সে। প্রতিদিন উৎপাদিব বা সংগ্রহকৃত কাঁকড়াগুলো তার বাড়ির পাশে সিলেট হ্যাচারীতে বিক্রি করেন। সপ্তাহ শেষে সেখান থেকে হিসাব করে টাকা সংগ্রহ করে পুনরায় আবারো ও কাচামাল হিসেবে শক্ত কাঁকড়া ক্রয় করেন খামারের জন্য। পানির উপরে বক্সের মাধ্যমের কাঁকড়া চাষের পাশাপাশি নিচের পানিতে পায়রা ও ভেটকি মাছ চাষ করছেন বলে জানান দূর্গা রানী।

এই ব্যবসায় লাভ ও লস দুটিই আছে বলে জানান তিনি। বর্তমানে তিনি ৮ হাজার টাকার মত লস করে আবারো পানি পরিবর্তন করে নতুন ভাবে প্রসেসিং করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তার নরম কাঁকড়া উৎপাদন খামারে গিয়ে দেখা যায়, পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন উপায়ে কাঁকড়া উৎপাদন কার্যক্রম। তাঁর স্বামী জানান, আমি প্রায় বাইরে জন-মজুরী দেই। আমার স্ত্রী এই খামারটি পরিচালনা করে। এই কাঁকড়ার খামার থেকে তিনি ২৫ হাজার টাকা লাভ করে এসফোর আই হিসেবে জমা রেখে আবারো তার খামারে তিনি উক্ত টাকা বিনিয়োগ করেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় দূর্গা রানীর নরম কাঁকড়া উৎপাদন খামার উপকূলীয় এলাকার আগ্রহী নারীদের আরো উদ্যোগী করে তুলবে। এমনিভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা নিজেদের আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নিজেরা ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

happy wheels 2

Comments