প্রকৃতির সকল প্রাণসত্তার জন্য একটি সুন্দর ‘অংশীদারিত্বমূলক ভবিষ্যত’ গড়ে তুলি
সিলভানুস লামিন
২২ মে, আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র দিবস। প্রতিবছরই এ দিবসটি পালন করা হয়। প্রাণবৈচিত্র্য বা জীববৈচিত্র্য প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব, উপকারিতা এবং প্রকৃতি ও পরিবেশে এর প্রভাব সম্পর্কে সচেনতা তৈরির জন্য মূলত এ দিবস পালন করা হয়। এ বছরের (২০২২) আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “Building a shared future for all life”” বাংলা করলে সম্ভবত এই অর্থ বহন করে ‘প্রতিটি প্রাণের জন্য একটি অংশীদারিত্বমূলক ভবিষ্যত তৈরি’। এই দিবস পালনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক জগতের সাথে আমাদের সম্পর্কগুলোকে পুনঃমূল্যায়ন করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। তবে সত্যি যে, প্রযুক্তিগত অনেক উন্নয়নের পরও আমরা কিন্তু এখনও একটি পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী প্রতিবেশ এর উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা পানির জন্য, খাবারের জন্য, ওষুধের জন্য! এই নির্ভরশীলতা বস্ত্রের জন্য, জ্বালানির জন্য, শক্তির জন্য এবং এ নির্ভরশীলতা আশ্রয়স্থলের জন্য। এছাড়া আরও অনেককিছুর জন্য আমরা প্রকৃতি ও প্রতিবেশের ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি ও প্রতিবেশের উদার দান ব্যক্তিত আমরা প্রযুক্তিগত যতই উন্নয়ন করি না কেন আমাদের সত্যিকার উন্নয়ন কিন্তু সম্ভব না।
এ বছরের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য যথার্থই বলা চলে। কারণ শুধু মানুষের কল্যাণের কথা এখানে বলা হয়নি; বরং প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণসত্তার বিষয়টি উল্লেখ্য করা হয়েছে। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ যখন ভালো থাকবে, তাদের ভবিষ্যত তথা তাদের ভালো থাকা নিশ্চিত হবে একমাত্র তখনই এই পৃথিবী ভালো থাকবে। মানুষসহ সকল প্রাণের খাদ্য, বাসস্থান নিশ্চিত হবে। আমরা যে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের কথা বলছি সেটি কখনও অর্জন করা সম্ভব হবে না যদি শুধু মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণের বিষয়টিই প্রধান্য পায় আমাদের উন্নয়ন উদ্যোগসমূহে। এই প্রতিপাদ্য এমনই বার্তা দিয়েছে যে, আমাদের সব ধরনের স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের ভিত্তি হচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্য। আমরা ইতিমধ্যে প্রকৃতির যা বিনাশ করেছি, যা ধ্বংস করেছি বা যা ক্ষতি করেছি প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে সেগুলো পুনরায় পুনর্বিন্যাস করতে পারি।
আমরা জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে যে সব প্রতিবেশভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগুচ্ছি কিংবা আমাদের স্বাস্থ্য, পানীয় সমস্যা বা স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা অর্জনের জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছি সেগুলো অর্জনে প্রাণবৈচিত্র্যকে ‘ভিত্তি’ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। কারণ প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষিত না হলে এসব উন্নয়ন উদ্যোগে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়।
আমরা যখন প্রাণবৈচিত্র্য বলি অনেক সময় এ শব্দকে সংকোচিত করে ফেলি। আমরা মনে করি প্রাণবৈচিত্র্যই মানে অনেকগুলো প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী এবং প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন প্রাণসত্তা! কিন্তু প্রাণবৈচিত্র্য বলতে প্রতিটি প্রাণসত্তার ভেতরকার জেনেটিক ভিন্নতাকেও বুঝায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, শস্য প্রজাতি বা প্রাণীসম্পদ প্রজাতির মধ্যকার অনেকগুলো বৈচিত্র্য ও জেনেটিক ভিন্নতা রয়েছে, যা পরস্পরের সাথে অনবরত মিথষ্ক্রিয়া করে। অন্যদিকে প্রতিবেশে যেমন রয়েছে লেক, বন, মরুভূমি, কৃষিভূমি ইত্যাদি। এগুলো কিন্তু পরস্পরের বা তাদের সদস্যদের (মানুষ, উদ্ভিদ, প্রাণী) সাথে ক্রমাগতভাবে মিথস্ক্রিয়া করে। প্রাণবৈচিত্র্য তাই একটি বৃহত্তর ধারণা এবং এর সব উপাদানকে বিবেচনায় আনতে হবে যখনই কোন উন্নয়ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অন্যদিকে মানবসভ্যতা কিন্তু গড়ে উঠেছে প্রাণবৈচিত্র্যকে ভিত্তি করে। প্রাণবৈচিত্র্যই মূলত এই সভ্যতার পিলার বা স্তম্ভ। মাছ বিশ্বের মানুষের জন্য ২০ ভাগ প্রাণীজ প্রোটিন প্রদান করে, ৮০ ভাগ মানুষের খাবার প্রদান করে উদ্ভিদ এবং গ্রামাঞ্চলের ৮০ ভাগ মানুষের ওষুধ প্রদান করে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন গুল্ম, উদ্ভিদ! তাই প্রাণবৈচিত্র্যকে বাদ দিয়ে কোন উন্নয়ন হতে পারে না এবং সভ্যতা গড়ে উঠে না। প্রাণবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি তাই কোনভাবেই কাম্য নয়। প্রাণবৈচিত্র্য না থাকলে মানুষে নানান ধরনের রোগ আক্রান্ত হবে। তবে প্রাণবৈচিত্র্যকে আমরা যদি বরণ করি, সুরক্ষা করি এবং এর প্রকৃত ব্যবহার রপ্ত করি তাহলে বিশ্বে করোনার মত অনেকগুলো মহামারির সাথে লড়াইয়ের রসদ পাবো। তাই আসুন প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা করি, সংরক্ষণ করি এবং এর বিলুপ্তিরোধে উদ্যোগ নিই। এভাবেই আমরা মানুষসহ প্রকৃতির সব ধরনের প্রাণসত্তার জন্য একটি সুরক্ষিত ও অংশীদারিত্বমূলক ভবিষ্যত রচনা করতে পারবো।