ফসলের হাসপাতাল!

:: নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান

Untitle্িd-1একটি কৃষি ফসলের হাসপাতাল
মানুষের জন্য হাসপাতাল, পশু-প্রাণীর জন্য হাসপাতাল দেশে বা বিদেশে রয়েছে ভুরি ভুরি। কিন্তু কৃষি ফসলের জন্য হাসপাতাল! তাও আবার গ্রামের কৃষকদের উদ্যোগে! কোথাও কি এমন হাসপাতাল দেখেছেন? না দেখে থাকলে আপনারা যেতে পারেন আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউয়িনে। নেত্রকোনা মদন রোডের দূর্গাশ্রম গ্রামের চৌরাস্তায় বাঘরা হাওরের মাঝামাঝি স্থানে প্রতিষ্ঠিত এই কৃষি ফসলের হাসপাতাল! বাঘরা হাওর কৃষক সংগঠনের উদ্যোগেই মূলত এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা তাঁদের কৃষি সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো অভিজ্ঞ কৃষকদের সাথে সহভাগিতা করেন এবং এসব সমস্যা সমাধানে অভিজ্ঞ কৃষকদের কাছ থেকে পরামর্শ ও নির্দেশনা গ্রহণ করেন। কৃষি ফসলের হাসপাতালে একক কোন অভিজ্ঞ কৃষক বসেন না; কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ অনেক কৃষকই বসেন এইখানে! এভাবে প্রতিমাসের ৩০ তারিখে কৃষকরা হাসপাতালে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। কৃষকরা সবাই বিভিন্ন রোগাক্রান্ত ফসলের গাছও নিয়ে আসেন। প্রশিক্ষক অভিজ্ঞ কৃষকরা এসব সমস্যা শুনেন, রোগাক্রান্ত কৃষি ফসলগুলো দেখেন। এরপর তারা পরস্পরের সাথে আলোচনা করেন। সম্মিলিতভাবে নির্ণয় করেন রোগ, রোগের কারণ। কৃষির ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কৃষকদের আলোচনায় বেরিয়ে আসে সমাধানও। এ হাসপাতালে আছে বিভিন্ন উপকারী ও অপকারী পোকার ছবি, রোগের লক্ষণ, সমাধানের উপায় এবং কৃষির বিভিন্ন ধরনের তথ্যও। অভিজ্ঞ কৃষকরা উপস্থিত সব কৃষককে শিখিয়ে দেন কিভাবে তারা পোকা চিনবেন, দমন করবেন, চিকিৎসা করবেন এবং জৈব সার ও বালাইনাশক তৈরি করবেন। এভাবে কৃষকরা তাদের নানান সমস্যা সমাধান লাভ করেন এবং পরস্পরের সাথে সহভাগিতার মাধ্যমে কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের যাত্রাপথ দিনকে দিন প্রসারিত হচ্ছে অন্য কৃষকের মাঝে, অন্য গ্রামে এবং অন্য এলাকায়ও!

এটি তথ্য ও কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের বিনিময় কেন্দ্রও
বাঘরা হাওর কৃষক সংগঠনের এই জনতথ্য কেন্দ্র, এই ফসলের হাসপাতাল কৃষকের কৃষি সমস্যাই সমাধান করে না। এলাকার কৃষকরা কৃষির নানা তথ্য, জৈবকৃষি চর্চার তথ্য, বীজ আদান-প্রদান, গ্রামীণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন, দিবস পালনের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি, ফসলের ন্যায্য মূল্য, কৃষি ভর্তূকী নিয়ে সাংবাাদিক সম্মেলন, কৃষকের অধিকার আদায়, বিভিন্ন পেশার মানুষের সম্পর্কের জায়গা তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে বর্তমানে কাজ করছে। কৃষি ফসলের এই হাসপাতালে আছেন জৈবকৃষি চর্চাকারী কৃষকগণ। যাঁরা জৈব উপায়ে কৃষি চর্চার সফলতার দিক এবং চর্চার বিভিন্ন দিক হাতে কলমে কৃষকদের সাথে সহভাগিতা করেন। কৃষকরা এই হাসপাতালে এসে কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য যেমন লাভ করেন তেমনিভাবে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি ফসল আবাদ এবং কৃষি সমস্যা সমাধানের নানামূখী তথ্য ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছেন। প্রতিমাসে কৃষকদের সভার মাধ্যমে কৃষিসহ জীবনের নানান বিষয় নিয়ে কৃষকরা পরস্পরের সাথে সহভাগিতা করেন। এতে করে তাঁদের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্ক যেমন উন্নতি হচ্ছে তেমনিভাবে পরস্পরের সাথে কৃষি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে বিনিময় সংস্কৃতিও পুর্নজীবিত করছে।

কৃষি ফসলের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার নেপথ্য
বাঘরা কৃষক সংগঠনের কৃষকেরা ২০০৮ থেকে বীজের সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষক নেতৃত্বে ধানের জাত গবেষণা করে বীজের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন। আগে যেখানে ৪/৫ জাতের ধান চাষ করা হতো বর্তমানে সেখানে ৩৭ জাতের ধানের চাষ হয়। পানি সমস্যা সমানের জন্য একক ফসল ধানের পরিবর্তে বর্তমানে নানা জাতের সবজি, মসলা, ডাল জাতীয় ফসল ও গম চাষ করছেন। কিন্তু পোকার আক্রমণের কথা প্রতিদিনই কৃষকের মাঝে শোনা যায়। সংগঠনের মাসিক সভায় প্রায় প্রতিটি কৃষকের কাছ থেকে ফসলে পোকার আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ শুনতে পান এই সংগঠনের সদস্যরা। এছাড়া সভায় তাঁরা জৈব উপায়ে কীভাবে পোকা দমন, সার ও কীটনাশক তৈরি করে সফল হওয়া যায় সে সম্পর্কে বিভিন্ন কৃষকদের আলোচনা থেকে জানতে পারেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বাঘরা কৃষক সংগঠনের সভাপতি কালা মিয়া এবং কৃষক আ. ওয়াদুদ খান জানান, যেহেতু প্রায় প্রতিটি সদস্য কৃষকরাই পোকার আক্রমণ এবং এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ তাঁদের কাছ থেকে চান, সেজন্য তাঁরা মনে করেন এসব সমস্যা সমাধান করা উচিত। তাঁরা আরও জানান, সভায় জৈব উপায়ে পোকামাকড় দমন করে সাফল্য পেয়েছেন এমন কৃষকও তাদের সফলতার কথা সহভাগিতা করেন। তাই তাঁরা মনে করেন, এ অভিজ্ঞ কৃষকরা তাঁদের অভিজ্ঞতা হাতে কলমে অন্যদেরকে প্রশিক্ষণ দিলে অন্যরাও পোকার আক্রমণজনিত সমস্যার সমাধান পেতে পারেন। তাঁরা বলেন, “কৃষকদের এসব সমস্যা কৃষকদের মাধ্যমে সমাধানের জন্য আমরা সবাই মিলে একটি ফসলের চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিই। সবার চিন্তার সমন্বয় করে সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, ফসলের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করা হবে এবং সবাই এতে সম্মতি জানান। এভাবেই কৃষি ফসলের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়।”

উপসংহার
কৃষি প্রধান এই দেশে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা, দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জীবন-জীবিকা উন্নয়নের চাকা সব কিছুই কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই সভ্যতা। কৃষকের আপন কৃষি, জ্ঞান, বীজ, সার, প্রযুক্তি দিনদিন পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পোকার আক্রমণ বা বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে ফসলহানি এখন একটি নিত্যনৈমক্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে কৃষিতে কৃষকের লাভ নেই; আছে কেবল দুর্ভোগ। পোকা দমনে কৃষক না জেনে না বুঝে অবাধে ব্যবহার করছে বিষ, কীটনাশক, বিষাক্ত হয়ে উঠছে মাটি, পানি, বাতাস, পরিবেশ প্রকৃতি। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানা জটিল রোগে। তাই প্রয়োজন ফসলের চিকিৎসার জন্য জায়গা তৈরি করার। যে ফসল জীবন ও জীবিকার একমাত্র অবলম্বন সেই ফসলের চিকিৎসার জন্য নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউয়িনের বাঘরা হাওর কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে এই কৃষি ফসলের হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। সরকারের কৃষি অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয় কিংবা বিএডিসিসহ কৃষিসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কৃষককে পরামর্শ দেওয়ার জন্য গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার পাশাপাশি কৃষকদের আপন অভিজ্ঞতায় ও উদ্যোগে এরকম কৃষি ফসলের হাসপাতাল বা কেন্দ্র যাই বলি না কেন অবশ্যই প্রয়োজন। নেত্রকোনার কৃষকদের এই উদ্যোগে অন্য এলাকার কৃষকদের উৎসাহিত করবে।

happy wheels 2

Comments