প্রকৃতির রুদ্ররূপে দুঃসহ জীবনযাপন করছে সকল প্রাণী

রাজশাহী থেকে অমিত সরকার

পৃথিবী গ্রহে নতুন প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ। তাপপ্রবাহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকেই শুধু অস্বস্তিকর করে তুলে না, মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্যও মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি এবং দাবানলের ঝুঁকি বাড়াতে ক্রমবর্ধমান তাপপ্রবাহ যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে সেটি তো এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।

যার ফলে এই বৈশাখী খরতাপে পুড়ছে পদ্মাপাড়ের শহর রাজশাহী। তীব্র তাপদাহে বাতাসেও যেন আগুনের ছটা। কাঠফাটা রোদ আর ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। গরমের তীব্রতায় মানুষসহ পশু-পাখিরাও যেন হাঁসফাঁস করছে। ঘরে বাইরে কোথাও এতটুকু যেন স্বস্তি নেই। সবখানেই গরম। গরমে কাহিল হয়ে অনেকে একটু স্বস্তির আশায় বসছেন গাছের নিচে। খরতাপে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে সবুজ রাজশাহী।

এই তাপদহনে সবথেকে বেশি ঝুকি ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন নগরের ভূমিহীন মানুষ গুলো। সরজমিন ঘুরে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রেললাইন এর পাশে  বুধপাড়া বস্তীতে নাসিমা বেগম (৪০+) দুটি টিনের ঘর করে চার সন্তান ও তার স্বামীকে নিয়ে বসবাস করেন। নাসিমা বেগম এর স্বামী আসাদুল ইসলাম অটোরিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ জোগান। নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী এমনি স্বাভাবিক সময়ে অটো চালিয়ে দিনে ৭০০/৮০০ টাকা করে ইনকাম করতো কিন্তু এখন এই গরমে রাস্তায় মানুষ কম তারপর বেশি সময় গাড়িও চালানো যায়না। আর গাড়ি তো নষ্ট হয় বেশি। এখন দিন ৩০০/৪০০ টাকা কামাই করাই জলুম। “

একই বস্তির মাজেদা বেগম (৫৫+) বলেন, ‘এই গরমে আমাদের এখানে অনেকের ডাইরিয়া হচ্ছে বাচ্চাদের বেশি হচ্ছে। আমরা গরমে সারাদিন ঘরে ঢুকতে পারিনা টিনের ঘর আরও বেশি গরম হয়ে থাকে ঘরে থাকা যায়না। আমরা বাইরে গাছের নিচে ছায়ায় থাকি সারাদিন, রাত হলে ঘরে ঢুকি। গরম থেকে বাঁচতে আমরা লেবু পানি, স্যালাইন পানি, আখের গুড় এর সরবত, খাচ্ছি। এখন আলু কম খাই। আলু শরীর গরম করে আমরা কাঁচা কলা, পেপে, লাউ, কচু রান্না করে খাচ্ছি এখন। এগুলো শরীর ঠান্ডা রাখে। মাছ মাংস ডিম তো আমাদের এমনিতেই খুব একটা জুটেনা। এই গরম সময়ে এগুলো আমরা আরও খাইনা।” পাশের ঘরের রহিমা বেগম (৬৫+) গরমে প্রেসার বেড়ে যায় ঘনঘন। উনি এখন নিয়মিত পেসার এর ঔষধ খেয়ে তীব্র তাপ মোকাবেলা করার চেষ্টা করছেন। 

অন্যদিকে নগরের ভদ্রা এলাকার জামালপুর বস্তিতে রাবেয়া বেগম (৩৫) এর টিনের ঘর বেশ ঠান্ডা হয়ে থাকে সবসময় কারণ তার বাড়ির চালায় সিমের গাছ তুলে দিয়েছেন। রাবেয়া বেগম বলেন, ‘যাদের ঘরের চালায় গাছ নেই তারা দিনের বেলায় ঘরে ঢুকতে পারেনা কিন্তু আমার ঘরে সিমের গাছ তুলে দেওয়ার পর থেকে ঘর ঠান্ডা থাকে সবসময়। এত গরম ও রোদেও আমার ঘর গরম হয়না।’ শুধু রাবেয়া বেগম নয়। তার মতন জামালপুর, নামোভদ্রা, বহরমপুরসহ নগরীর নগর প্রান্তিক মানুষেরা বারসিক রাজশাহীর সহযোগিতায় টিনের চালায় লাও, সিম, কুমড়ো,পুইসহ লতা জাতীয় সবজি চাষ করে তারা একদিকে তাদের পুষ্টি চাহিদা মিটাচ্ছেন পাশাপাশি এই গরম ও তাপ মোকাবিলা করছেন। 

রাজশাহী নগরীতে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা সেলিম রেজা (৩৫) বলেন, ‘আমার জীবনে এত তাপ আমি কখনও দেখিনি। রাস্তায় বেলা বারার সাথে সাথে তাপও বাড়ে চোখ মুখ যেনো পুরে যায় তাপে। গরম আর তাপ শুরু হওয়ার পর থেকে আমার ইনকাম কমে অর্ধেক হয়েছে। রোজার মাস খরচ আগের থেকে বেড়ে গেছে। রিকশা চালাতে কষ্ট হয় গরমে। গামছা ভিজিয়ে মাথায় দিয়ে রিকশা চালাই। তবুও গরম হয়ে যায় মাথা। কিছু করার নেই কারণ ঘরে বসে থাকলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে আমাদের।’ 

জলবায়ু পরিবর্তন সবাইকে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। প্রভাবগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে দরিদ্রদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতে তাপপ্রবাহকে আরও তীব্র করে তুলবে। তার মানে, এই বিপর্যয় এড়ানোর আর সুযোগ নেই। তাহলে এই দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায় হলো অভিযোজন। 

চৈত্র মাসের শেষদিকে বাংলাদেশে এমন তীব্র গরম অস্বাভাবিক নয়। দেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ঋতু বৈচিত্র্যের জন্য চৈত্র মাসে এ সময় গরম বা দাবদাহ যুগ যুগ ধরে ছিল। তবে বছরে কতদিন ও কত সময় ধরে তাপপ্রবাহ স্থায়ী হচ্ছে তা ভাবনার বিষয়। কারণ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর ভূমির তাপমাত্রা দিনকে দিন  দীর্ঘায়িত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সব থেকে বেশি দায়ী দেশগুলোর আরও দায়িত্বশীল হতে ও কার্যক্ররী পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করতে আমাদের সকলের সোচ্চার হওয়া জরুরি। পাশাপাশি সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও অভিযোজন কৌশলগুলো প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন জরুরি। 

happy wheels 2

Comments