সাম্প্রতিক পোস্ট

সুমিত্রার স্বপ্ন পূরণের পথে

ঘিওর, মানিকগঞ্জ থেকে সুবীর কুমার সরকার
রীতা রানী মন্ডলের জন্ম ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি গাংডুরী গ্রামে। বাবা প্রফুল্ল মন্ডল, মাতা সন্ধা রানী মন্ডলে আদরের কন্যা সন্তান। রীতা রানী মন্ডল বড় হওয়ার পর বাবা-মা সামাজিক নিয়ম অনুসারে বিয়ে দেন চর হিজলাইন গ্রামের সাইকেল মেকার গোবিন্দ বালোর সাথে। বিয়ের পর রীতা মন্ডল স্বামীর বালো উপাধি নামের শেষে যোগ করে হয়ে যায় রীতা বালো। রীতা বালোর শ^াশুরি টাকার লোভে ছেলেকে বিয়ে করান। রীতা বালোর জীবনের কথা শুরু করেন বিবাহিত জীবনের গল্প থেকেই। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী বিয়ের আগে থেকেই ছিলো অসুস্থ, বিয়ের সময় আমার শশুর বাড়ির লোকেরা গোপন করে বিয়ে দেন। কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারি আমার স্বামী অসুস্থ। আমি আমার মা বাবাকে স্বামীর অসুস্থের কথা বলি কিন্তু মা বাবা বিশ্বাস করে না। আমার স্বামী সংসারে কোন কাজ কর্ম করতে পারেনা। সংসারে অভাব দেখা দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিবাহিত জীবনের দশ মাসের মাথায় আমি মা হতে চলি। চার মাসের মাথায় আমার ব্লিডিং শুরু হয় এবং প্রসবের আগেই আট মাসে কন্যা সন্তানের জন্মদেই। কন্যা সন্তান বড় হতে থাকে কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে যে স্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায় আমার কন্যা মধ্যে তেমন লক্ষণ দেখা যায় না। তাই ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। সেখান থেকে আমার কন্যা সূমিত্রা বালোকে প্রতিবন্ধী ঘোষণা করেন ডাক্তার।’


ঘিওর উপজেলার নালী ইউনিয়নের কেল্লাই বাজার থেকে এক কিলোমিটার মাটির মেঠো পথ পেরোলে ৩২ নং গাংডুবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ক্ষিরাই নদী আর নদীর পাশ দিয়ে গাংডুবী গ্রাম। সেই গ্রামে সুমিত্রার বসবাস। এ বিদ্যালয়েই প্রাথমিক পড়াশোনা করেছে সুমিত্রা। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে সে এখন কেল্লাই মুনসুর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। তবে সুমিত্রার জীবনের গল্প আর দশজনের মতো মসৃণ নয়। জন্মের পর থেকেই সুমিত্রা বালো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। দুই পা অবশ। সমস্যা রয়েছে এক হাতেও। এসবের কিছুই দমাতে পারেনি সুমিত্রাকে। বুকে ভর আর হামাগুড়ি দিয়ে ১০ বছর ধরে স্কুলে করেছে সে। বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী মেয়ে সুমিত্রার কথাবার্তা বেশ সুস্পষ্ট।


প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় শুর হয় রীতা বালোর তার কন্যাকে নিয়ে সংগ্রামী জীবন। হাঁস-মুরগি, কবুতর, ছাগল পালন করে যে আয় হতো তা দিয়েই চলে মা-মেয়ের জীবন। সুমিত্রা পড়াশোনা চালিয়ে যায়। পেরোতে থাকে একের পর এক শ্রেণী। স্বপ্ন দেখতে থাকে তার মতো প্রতিবন্ধকতার শিকার মেয়েদের এগিয়ে নেওয়ার। সমাজের সব মানুষের সেবা করার। ২০১৪ সালে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে সুমিত্রাকে দেওয়া হয় প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড। এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। সুমিত্রা এখন বড় হয়েছে, সামনে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। নেই জমি, নেই ঘর।


মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার নালী ইউনিয়নের গাংডুবী কৃষক সংগঠনের সভাপতির প্রফুল্ল মন্ডলের মেয়ের ঘরের নাতনি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু, অদম্য সুমিত্রা’ বালো পরিবারকে একটি পাকা ভবন তৈরী করে দিচ্ছে ঘিওর উপজেলা প্রশাসন। এমন একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ এবং আরটিভির প্রযোজক ও উপস্থাপক সৈয়দা মুনীরা ইসলাম। একজন বারসিক’র কর্মী হিসেবে আমি সুমিত্রার স্বপ্নের পথের যাত্রী, সুমিত্রা বালো তৃতীয় শ্রেণীতে থাকা কালে বারসিক’র সহযোগিতায় একটি স্কুল ব্যাগ দিয়ে সহযোগিতা ও লেখা পড়ার ও বাড়িতে হাসঁ, মুরগি, কবুতর,ছাগল পালনের পরামর্শ দেয়া হয়। সুমিত্রাকে নিয়ে সাংবাদিক মো. জাহাঙ্গীর আলম বিশ^াসের সহযোগিতায় আরটিভিতে বিশেষ প্রতিবেদন হওয়ার পর সুমিত্রা’র জীবনের চ্যালেঞ্জগুলি প্রশাসনের নজরে আসে। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমিত্রাকে নিয়মিতভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে আরটিভি কর্তৃপক্ষ এবং ঘিওর উপজেলা প্রশাসন।


গত মাসে সুমিত্রাকে দেওয়া হয়েছে উন্নতমানের হুইলচেয়ার। সরকারি বন্দোবস্তে ২ শতক জমি ও সুদৃশ্য পাকা ঘর। মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আবদুল লতিফের তত্ত্বাবধানে ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হামিদুর রহমানের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছে। সুমিত্রা বালোর ঘরের নির্মাণ কাজ তদারকি করেছেন ইউএনও হামিদুর রহমান। চলতি মাসের মধ্যেই পরিপূর্ণ হবে নির্মাণকাজ। ইউএনও বলেন, ‘‘সুমিত্রা মেধাবী শিক্ষার্থী। ভূমিহীন সুমিত্রা বালোর পরিবারকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাকা ঘরটি নির্মাণ করে দিতে পারায় আমি অনেক খুশি। পর্যায়ক্রমে তাদের স্বাবলম্বী করতে আরও কিছু করা পরিকল্পনা আছে’’। শারীরিক প্রতিবন্ধী সুমিত্রা বালো (১৫) বলে- ‘‘নতুন ঘর পেয়েছি। হুইলচেয়ার পেয়েছি এখন আমি সহজেই স্কুলে যাই। আপনারা আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন। বড় হয়ে আমিও অসহায়দের পাশে দাঁড়াব। চলাচল সহায়ক হুইলচেয়ার, ভাতা, ২ শতাংশ জমি ও ১৯/২২ ফুটের পাকা ঘর পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জেলা প্রশানক ও ইউএনওকে আরটিভির প্রযোজক ও উপস্থাপক সৈয়দা মুনীরা ইসলাম, বারসিক, স্থানীয় প্রতিবেশীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন সুমিত্রা ও তার পরিবার। অদম্য সাহস শক্তিতে এগিয়ে যাও সুমিত্রা বালো।

happy wheels 2

Comments