কৃষিতে সফল নারী কবিতা রাণী

মানিকগঞ্জ থেকে কমল চন্দ্র দত্ত

মানিকগঞ্জ পৌরসভাধীন সুবিধা বঞ্চিত ও অবহেলিত একটি জায়গা উচুটিয়া লৌহকার পাড়া। এখনও ভাঙা বাঁশের ব্রিজ পেরিয়ে এই গ্রামে যেতে হয়। কবিতা রাণী লৌহকার (৪২) এই গ্রামেরই একজন গৃহবধু। স্বামী সাধু লৌহকারের (৪৭) সাথে ২০ বছর যাবৎ সংসার জীবনযাপন করছেন। তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। স্বামী-স্ত্রী ও দুই ছেলে। বিবাহিত জীবনের শুরু থেকেই অভাব অনটনের সংসারে দিন কাটে তাঁর। স্বামী কুলির কাজ করে যে টাকা উপার্জন করতেন তা দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেই জন্ম হয় বড় ছেলে সুমন লৌহকারের (১৮)। এর তিন বছর পর জন্ম হয় ছোট ছেলে সুজন লৌহকারের (১৫)। সংসারের খরচ বাড়তে থাকে। দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। কি করবেন ভেবে কুল পান না। গৃহস্থালী কাজ ছাড়া অন্যকোনো কাজের অভিজ্ঞতাও ছিল না তার। এমন সময় বারসিক নামে একটি এনজিও তাদের এলাকায় প্রান্তিক শিশুদের লেখাপড়ার জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরিচয় হয় বারসিক কর্মকর্তাদের সাথে। তিনি বড় ছেলেকে শিশু বিকাশ কেন্দ্রে ভর্তি করে দেন। বারসিক প্রান্তিক শিশুদের লেখাপড়ায় সহায়তা দানের পাশাপাশি মায়েদের নিয়ে সংগঠন তৈরি করে। নারীদের আয়বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত হবার জন্য বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও ব্যয় সাশ্রয়ে ভ’মিকা রাথার জন্য ঋতুভিত্তিক সবজি চাষ ও পশুপাখি পালনে পরামর্শ ও উৎসাহ দেন।

কবিতা রাণীর সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ছোট ছেলে কোলে থাকায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি বসে থাকেননি। বেঁচে থাকার তাগিদে ও ছেলেদের কষ্ট লাঘবের জন্য কবিতা রাণী জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি বারসিক’র পরামর্শ অনুযায়ী বসতভিটায় হাঁস, মুরগি ও কবুতর পালন এবং রাস্তার ধারে ও বসতভিটার চাল ব্যবহার করে সবজি চাষ শুরু করেন। বারসিক তাঁকে বীজ দিয়ে সহায়তা করে। এর পর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যে সবজি উৎপাদন হতো তা দিয়ে পরিবারের চাহিদা প্রায়ই মিটে যেত। হাঁস, মুরগি ও কবুতর পালন করে যে আয় হতো সেই অর্থ দিয়ে ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ অতিকষ্টে চলে যেতো। বড় ছেলে ২০২৩ সালে এস.এস.সি দিয়েছিল। দুর্ভাগ্য এক বিষয়ে পাশ করতে পারে নি। এবছর দুই ছেলেই এস.এস.সি দিবে। পারিবারিক সবজি চাষে ব্যয় সাশ্রয় হওয়ায় সবজি চাষের প্রতি তার আগ্রহ বেড়ে যায়। তার ইচ্ছা ছিল একটু জায়গা কিনে সব ধরণের সবজি চাষ করার। নিজের ও স্বামীর কঠোর পরিশ্রমে সঞ্চিত কিছু অর্থ ও ঋণ নিয়ে অবশেষে ২০১৯ সালে ৬ শতাংশ জায়গা কিনে সবজি চাষ শুরু করেন। বর্তমানে তিনি তার সবজি বাগানে দেশী লাউ, মিষ্টি লাউ, আলু, মিষ্টি আলু, বেগুন, টমেটো, শিম, বন শিম, বরবটি, পেঁপে, চাল কুমড়া, ধন্দুল, ঝিঙা,সোলা কচু, জংলা কচু, মান কচু, ডাটা, মূলা, করল্লা, চিচিঙ্গা (কহি), পালং শাক, লাল শাক, রাই সরিষা (শাক), হেলেঞ্চা, মরিচ, পিয়াজ রসুন, হলুদ, কাঁচকলা ইত্যাদি ঋতুভিত্তিক সবজি চাষ করেন। এছাড়া তার বাগনে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পিয়ারা, বেল, নারিকেল, বড়ই, পিছফল, কদবেল, চালতা, জলপাই, আমলকি ইত্যাদি ফলজ গাছ রয়েছে। কাঠ গাছের মধ্যে রয়েছে মেহগনি, কড়ই, মহানিম ও বনজিকা ইত্যাদি। সবজি চাষের পাশাপাশি তিনি মুরগি ও কবুতর পালন অব্যাহত রেখেছেন। বর্তমানে তার ৯টি বড় দেশী মুরগি (ডিম পাড়ে), ২৭টি ছোট মুরগি ও ৩০টি কবুতর রয়েছে।
তিনি সবজি চাষ ও পশুপাখি পালন করেই আবদ্ধ থাকেননি। বিক্রি সবজির আয় থেকে তিনি ধানী জমি কটে (গিরবি) রেখে ছেলেদের সাথে নিয়ে নিজেই চাষ করছেন। উৎপাদিত ধান থেকে তাদের পরিবারের ৮ মাসের খাদ্যের যোগান হচ্ছে। এ বছর তিনি ২৩ শতাংশ জমি কটে রেখে সরিষা বপন করেছেন।


কবিতা রাণী তাদের এলাকার একজন অনুসরণীয় ব্যক্তি। তাঁর কার্যক্রম দেখে উৎসাহিত হয়ে শিউলী রাণী লৌহকার, দিপালী রাণী লৌহকার, ঝর্ণা রাণী লৌহকার ও মিলন রাণী লৌহকার মুরগি ও কবুতর পালন, সবজি চাষ শুরু করেছেন। কবিতা রাণীর একটি মাত্রই ইচ্ছা আরও একটু জায়গা কিনে ছোটখাটো একটি খামার করা। যার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে ছেেেলদের একটু মানুষ করতে পারেন এবং পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে অন্যের খ্যদ্য চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারেন।

জন্মের পর থেকেই প্রত্যেককেই বেঁচে থাকার তাগিদে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে বড় হতে হয়। এমনই একজন নারী যাকে ছোট বেলা থেকেই অনেক সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছে।

happy wheels 2

Comments