হরিরামপুর চরে নারীদের জীবন সংগ্রাম
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে ঘাঠে বাড়িতে কঠোর পরিশ্রম করে যাঁরা জীবন জীবকায়নে সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন তাঁরা হলেন হরিরামপুর চরাঞ্চলের নারীরা। তাঁরা শুধু বাড়িতে নয়, চকে পাথরে তাদের কাজের প্রতিফলন দেখা যায়। সেলিমপুর গ্রামের একজন নারী কৃষক আকলিমা বেগম বলেন, অ‘ামরা চরে থাহি কামগাছ এর মধ্যে দিয়ে আমাগো দিনরাত পার হয়। সেই সকাল ঘুম থেকে উঠে কাজের ব্যবস্থা শুরু হয় আর সারাদিন কোন সময় বসে থাহি না। চরের প্রায় নারীই বাড়ির কামগাজ শেষ করে আবার গরুর খাদ্য সংগ্রহের জন্য চকে যাই।’
মানিকগঞ্জ হরিরামপুর উপজেলা পদ্মা নদী দ্বারা বিভক্ত চরাঞ্চল যেখানে প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষই কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। কৃষি তাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। চরের মাঠে ঘাটে রয়েছে বৈচিত্র্যময় ফসল। আর চরের প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে ৫-২৫টি পর্যন্ত গরু। এই সকল গরু-ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া লালন পালন, খাদ্য সংগ্রহ, গোয়াল ঘরে তোলা, চক পাথরে নিয়ে যাওয়া-আসা সকল প্রাণী সম্পদ পালনে বেশি ভাগ ভূমিকা রাখেন চরের নারীরা। একদিকে যেমন নারীরা ঘরের কাজ করতে হয়, তেমনি কৃষি কাজে পুরুষের কাজের পাশাপাশি তাদের কাজে সহযোগিতা করা। মাঠ থেকে ফসল সংগ্রহ করা, ফসল শুকানো, ঝাড়াই বাছাই করা, বীজ সংরক্ষণ করা নানান ধরনের কাজে নারীদের ভূমিকা রয়েছে। সেই সাথে প্রাণী সম্পদ পালনে চরের নারীদের অসামান্য অবদান রয়েছে। চরের অনেক নারী গরু, ছাগল ও ভেড়া পালনের মাধ্যমে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করেছেন।
হরিরামপুর পাটগ্রামচর, নটাখোলা, হালুয়াঘাটা, আন্ধারমানিক, কর্মকারকান্দি, বাহিরচর, আন্ধারমানিকসহ বিভিন্ন গ্রামে গড়ে তুলেছে কৃষকরা পারিবারিক ক্ষুদ্র গরু-ছাগলের খামার। পুরুষরা গরু ছাগল হাটে বাজারে নিয়ে যাওয়া বেচা কেনা করা, রাতে পাহাড়া দেওয়া, চিকিৎসা করা এ ধরনের কাজগুলো বেশি করে থাকেন। গঙ্গাধরদি গ্রামের কৃষক বিথী বেগম বলেন, ‘আমরা বাড়িতে গরু বাছুর পালতে কেনা খাবার খাওয়াতে হয় না। ফলে আমাদের খরচ কম হয় এবং লাভ বেশি হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আগামো চরে আগে ঘাসের অভাব ছিল না, এহন ঘাস কমা যাইতেছে। তার কারণ মানুষ দিন দিন পতিত জমিগুলো আবাদ করতাছে। আর ঘাস মারা বিষ দিয়া অনেক ঘাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়াও প্রতিবছর নদী ভাঙনের কারণে অনেক জমি জমা নদীতে চলে গেছে।’
প্রতিদিন সকালে বাড়ির কাজকর্ম সেরে চরাঞ্চলের নারীরা গবাদি প্রাণীর খাদ্য সংগ্রহে বেরিয়ে পড়েন। পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষে, ডোবা, খালের কিনারে, মাইটালে, প্রাকৃতিক জলাশয়ে থেকে নারীরা খাদ্য সংগ্রহ করে থাকেন। প্রাণীর সম্পদের খাদ্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে জল দুর্বা, দুর্বাঘাস, কাটা হেনসি, কাঁশবন, ছোন, কাইশ্যা, নলখাগড়া ঘাস, গোইচা, হেনসি, বাদলা, হামা, ছোট কলমী ও কস্তরী। এ সকল কাচা ঘাস গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও পায়রার ভূষি, গমের ভূষি, মাস কালাইয়ের ভূষি, খেসারী কালাইয়ের ভূষি, চালের খুদ, ধানের কুড়া, খড়, ভুট্টার পাতাসহ গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
চরবাসী মনে করেন, হরিরামপুর চরাঞ্চলসহ সকল এলাকায় প্রাণী সম্পদ পালন একটি লাভজনক পেশা ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। আর চরের এই প্রাণী সম্পদকে টিকিয়ে রাখতে রাসায়নিক সারবিষ, ঘাস মারা ঔষুধের ব্যবহার বন্ধে সবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখতে হবে চরবাসীর জীবন ও জীবিকার উপায়।