কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বিষে বিষে বিষক্ষয়, অর্থাৎ বিষাক্ত কিছু নষ্ট করতে হলে নাকি সেটা বিষ দিয়েই করতে হয়। যেমন বিষকাঁটালি দিয়ে আমরা ধানের ক্ষতিকারক পোকা দমন করি। কিন্তু বিশ (২০) এর মাঝে যে বিষ আছে সেটা কে জানতো? এই বিশ তো উল্টো আমাদের জীবন বিষে ভরে দিয়ে গেলো।
২০২০ সাল আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। করোনা ভাইরাস না এলে আমরা এতো কিছু শিখতামনা। বাঙালি সব সময় মিলে মিশে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু করোনা শিখিয়েছে নির্দিষ্ট দুরত্ব মেনে চলতে হবে, আমরা শিখেছি। বাংলাদেশের প্রকৃতি উদার, সেখানে আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠি। করোনা শিখিয়েছে, খোলা হাওয়ায় মুখ ঢেকে রাখতে হবে। আমরা তাই করছি। শুধু তাই নয়, মহামারী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে কারো সাথে হাত মেলানো যাবেনা, জড়িয়ে ধরা যাবে না। আমাদের শত কষ্ট হলেও আমরা নিজেদের আবেগকে সংবরণ করেছি।
করোনা আতঙ্কে জনজীবনে একসময় স্থবিরতা নেমে আসে। মহামারীর আক্রমণ ঠেকাতে বন্ধ করে দেয়া হয় দেশের সকল প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, যান চলাচল। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর যখন দেখা যায় দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে তখন আস্তে আস্তে খুলে দেয়া হয় বন্ধ করে রাখা সমস্ত প্রতিষ্ঠান।
দীর্ঘদিন নিজেদেরকে খাঁচায় আবদ্ধ রাখার পর আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। স্বাভাবিক চলাফেরা, কাজকর্ম সবকিছুতেই আমাদের পদচারণ শুরু হয়েছে। তবে কিছু অভ্যাস আমরা রপ্ত করেছি। সেগুলোকে সম্বল করে জীবন যুদ্ধে আবারও অবতীর্ণ হয়েছি। আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছি ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার্থীরা এখনো অবরুদ্ধই রয়ে গেছে। ১৬.০৩.২০২০ইং সাল থেকেই আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর থেকে দফায় দফায় ছুটি বেড়েই চলছে। বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে উপকরণের অভাবে ক্লাস নেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো। তাছাড়া গ্রামে ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীরা রীতিমতো পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়ার সাথেও যুক্ত হতে পারেনি। স্কুল/কলেজ ছুটি থাকাটা প্রথম প্রথম তারা আনন্দের সাথে গ্রহণ করলেও এই পরিস্থিতিটা এখন আর মানতে পারছেনা। দিন দিন হয়ে উঠছে অসহিষ্ণু।
শিক্ষার্থীরা সমবয়সীদের সাথে দল বেধে, খুনসুটিতে, আনন্দ করে স্কুল কলেজে যেতো। কিন্তু প্রায় দশ মাস যাবৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় সেই পরিবেশ থেকে তারা আজ বিচ্ছিন্ন। পাঠ্যবইয়ের সকল বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করে, সেখানে এই দীর্ঘ সময়ের নির্ল্পিপ্ততায় সকল শিক্ষার্থী অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগুচ্ছে। শুধু তাই নয়, পড়ালেখায় অমনোযোগি হওয়ার পাশাপাশি তারা নানা প্রকার অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তৈরি করছে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা।
যে সন্তানটি দিনের বেশিরভাগ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকতো, সে এখন হাতে মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাবা, মাসহ পরিবার ও প্রতিবেশিদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। খিটখিটে মেজাজ, অকারণে জেদ, বড়দের কথা না শোনা এগুলো এখন তাদের নিত্যকর্মে পরিণত হয়েছে।
বাড়িতে থেকে পড়াশুনা এখন আর তাদের ভালো লাগেনা। সমবয়সী বা বড়দের সাথে বাজারে বসে আড্ডা দিতে শিখেছে। সুযোগ পেলে অন্যের মোটর সাইকেল ভাড়া করে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। ঘোরাঘুরির খরচ মেটাতে বাবা মায়ের কাছে অধিক টাকার আবদার করে। আর তা যদি না পায় তবে অন্যের গাছের সুপারি, ক্ষেতের লাউ চুরি করতেও দ্বিধাবোধ করছেনা। বা রাতে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে পথচারীর কাছ থেকে টাকা কিংবা মোবাইল হাতিয়ে নিতেও শিখে গেছে।
সঙ্গ দোষে পড়ে অনেক ছেলেই এখন ধূমপান শুরু করেছে। প্রাইভেট পড়ার কথা বলে অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বন্ধুদের সাথে নদীর পাড়ে বা ঝোঁপের ধারে বসে ধূমপান করে। পাশের রাস্তা দিয়ে কোনো কিশোরী বা মেয়েকে দেখলে ইভটিজিং করতেও ছাড়েনা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুশ্রম বেড়ে গেছে। সংসারের অভাব দূর করতে বা ছেলেরা যাতে অসৎ সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য স্কুল পড়–য়া সন্তানদের বিভিন্ন দোকানে বা বাজারে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে তার পরিবার। করোনা পরিস্থিতির কারণে গ্রামে আবারও বাল্যবিয়ের প্রচলন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোতে। কারণ করোনার কারণে অনেকেই কর্মহীন, আয় রোজগার কমে গেছে। বিদ্যালয়ের উপবৃত্তির টাকায় যে মেয়েটির পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের টুকিটাকি খরচ চলতো, সেটি এখন বন্ধ আছে। তাছাড়া বাড়িতে রেখে মেয়েটিকে যে নির্বিঘেœ মানুষ করতে পারবে, এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেয়েদের জন্য নিরাপদ জায়গা। তাই পরিবারের খরচ কমাতে এবং মেয়েটিকে নিরাপদে রাখতে বাবা মা অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে বাল্যবিয়ের কারণে মেয়েরা অশিক্ষিত থাকার পাশাপাশি ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
শিক্ষা জাতির মেরুদ- বা শিক্ষার্থীরা জাতির ভবিষ্যৎ-দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই নীতিবাক্যগুলো এখন আর জোড় দিয়ে বলা যাচ্ছেনা। শিক্ষার অভাবে আমাদের সন্তানদের জীবন এখন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা করোনা প্রতিহত করতে গিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছি। ধ্বংস করে ফেলছি সম্ভাবনাময় জীবন। তাই কিভাবে করোনা মোকাবেলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়, করা সে বিষয়ে কোনো উপায় খুঁজে বের করাটাই সবার আগে প্রয়োজন। তা না হলে এই বিপদ (করোনা) আমাদের পিছনে ছুটতেই থাকবে। আমরা পালিয়ে বাঁচতে পারবোনা। এ প্রসঙ্গে আতকাপাড়া গ্রামের সাইফুল মুনশি একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ দিয়েছেন,
সঙ্গ ত কি অসঙ্গ ত,
লাফায়া, লাফায়া চলবাম কত ?
আগে যদি না মরতাম !
তাইলে কি আর বাঁচতাম ?
এখানে একটি গল্প আছে। গল্পটি এরকম, একটি সাপ ও ব্যাঙ এর মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। তারা একসাথে কিছুদিন সময় কাটায়। সাপ জঙ্গলের অন্যান্য প্রাণি ও ব্যাঙ খেয়ে শেষ করে। এবার আসে বন্ধুর পালা। সাপ তার বন্ধুত্ব ভুলে গিয়ে ব্যাঙটিকে খাওয়ার জন্য তাড়া করে। কিন্তু ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে চলার পরও সাপ তাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে। কোনো উপায় না পেয়ে ব্যাঙটি পানিতে লাফ দিয়ে মরে যাওয়ার ভান করে। সাপটি যখন দেখে ব্যাঙ মরে গেছে তখন সে ঐ জায়গা ছেড়ে চলে যায়। সুযোগ বুঝে ব্যাঙ জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যায়। এবং উপলব্ধি করে যে, বিপদ থেকে লাফিয়ে বা পালিয়ে বাঁচা যাবেনা। যদি বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হয় তবে বিপদকে প্রতিহত করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।