অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে নতুন প্রজন্ম
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
মানুষের চারপাশের প্রকৃতির উদারতা গ্রামীণ জনগণের চলার পথ বা বেঁচে থাকাকে আরো সহজ করেছে। হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে আসে থানকুনি, হেলঞ্চা, গিমাই এর মতো সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান পুষ্টিকর ও ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ সব খাদ্য ও ঔষধি পাতা। যুগের পর যুগ ধরে সমস্ত অচাষকৃত উদ্ভিদ একদিকে যেমন আমাদের নিরাপদ খাদ্যের যোগান দিয়ে আসছে, অন্যদিকে তেমনি চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এসবের অবদান অনস্বীকার্য। তাই এসব অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদের অবদানের কথা স্মরণ করে গ্রামাঞ্চলের কিছু ুকছু মানুষ এগুলো সংরক্ষণ করে নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখেন।
নেত্রকোনা জেলার মদনপুর ইউনিয়নের নরেন্দ্রনগর গ্রামের স্কুল শিক্ষার্থী রিন্তি আক্তার (১৯) তাদেরই একজন। তিন ভাই-বোনদের মধ্যে রিন্তী সবার ছোট। তাদের স্কুলে বারসিক আয়োজিত এক বিষয়ভিত্তিক (বক্তৃতামালা) আলোচনায় অংশগ্রহণ করে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য ও ঔষধি উদ্ভিদ সম্পর্কে জানতে পারে। মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে বৈশ্বিক মহামারী করেনাকালীন সংকটের সময়ে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় রিন্তী আক্তার অঢেল সময় পায়। এই সময়টাতে সে বাড়ি চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে যত ধরনের অচাষকৃত (কুড়িয়ে পাওয়া) খাদ্য উদ্ভিদ রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ ও সংগ্রহ করে প্রতিদিন নিয়মিত খেয়ে যাচ্ছে এবং গ্রামের সকলকে এগুলো সংরক্ষণ করে খাওয়ার পরামর্শ দেয়। সংগঠনের মাসিক সভার বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় সে এবিষয়ে সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়।
রিন্তি আক্তার বলেন, ‘আমাদের মা-চাচীরা তাদের আমলে সব সময় বাড়ির চারপাশে এমনি এমনি জন্মানো শাক ও ঔষধি উদ্ভিদ ও গাছ-গাছরা ব্যবহার করতেন। যার ফলে তাদেরকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি বললেই চলে। এসব নিরাপদ খাদ্য উদ্ভিদ খেয়ে তারা দৈনন্দিন পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও ঔষধের প্রয়োজন মিটিয়েছে। যেমন- টুনিমানকন (থানকুনি) এর পাতার রস বা ভর্তা খেলে পেট ফোলা, বদহজম, আমাশয় ও গ্যাষ্ট্রিক নিরাময় করে, বাসক পাতার রস ও তুলসী পাতার রস কাঁশির ঔষধ হিসেবে খুবই প্রচলিত। কলমী শাক খেলে মায়েদের বুকের দুধ বৃদ্ধি পায় ও শারীরিক দূর্বলতা দূর করে। হেলেঞ্চা শাক খেলে মূখে খাবারের রুচি বাড়ে ও বদহজম দূর করে।’
রিন্তী আক্তার আরও বলেন, ‘বাড়িতে আমি শাক খেতাম, তবে এসব অচাষকৃত শাক-সবজিও যে রান্না করে খাওয়া যায় তা আগে জানতাম না। মদনপুর শাহ্সুলতান উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে বারসিক’র কর্মীরা কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজির গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করায় আমরা শিক্ষার্থীরা মানুষসহ পশু-পাখির খাদ্য ও চিকিৎসায় কুড়িয়ে পাওয়া এসব শাক-সবজি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তখন থেকেই আমি বাড়িতে এসে যেখানে কুড়িয়ে পাওয়া শাক পাই তা সংগহ করে সেগুলোর গুণাগুণ সম্পর্কে দাদীর কাছে জানার চেষ্টা করি। তাছাড়া কিছু মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে অচাষকৃত এসব বৈচিত্র্যময় খাদ্য উদ্ভিদ ব্যবহর করে। যারা ভেষজ ঔষধ ব্যবহারকারী বা কবিরাজী পেশার সাথে যুক্ত তাঁরা মানুষ ও গবাদি পশু-পাখির বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের চিকিৎসা করে পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন।’
রিন্তী আক্তার নিজে জমিতে কচু, কুইড়াশাকা, পালইশাক, হেলেঞ্চা (হেইচা), দলকলস সংরক্ষণ করে নিজে নিজে নিয়মিত খায় এবং বাজারেও বিক্রি করে। এসব অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ চাষ করতে হয়না বলে কোন ধরণের যতœ এবং সার ও বিষ ব্যবহার করতে হয় না। ফলে এগুলো পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত, এগুলো হাতের কাছেই পাওয়া যায়। এগুলোর কোনটি পেটের পীড়া নিরাময়ে উপকারী, কোনটি চোখের জ্যোতি বাড়াতে, কোনটি হাত ও পায়ের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। রিন্তি আক্তার সংগঠনের মাসিক সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে এবং গ্রামের গর্ভবতী মায়েদেরকে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য উদ্ভিদ দিয়ে সহযোগিতা করে। এবিষয়ে রিন্তী আক্তার বলেন, ‘আমরা যারা নতুন প্রজন্মে রয়েছি, সবারই জানা উচিত এসব প্রত্যেকটি অচাষকৃত শাক-সবজির গুণাগুণ সর্ম্পকে জানা। প্রত্যেকেরই উচিত নিজ নিজ বাড়ির চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এসব খাদ্য উদ্ভিদগুলো সংরক্ষণ করা। আমার বাড়ির চারপাশে ১৫ জাতের কুড়িয়া পাওয়া শাক-সবজি আছে, যা আমি নিজেই সংরক্ষণ করে নিয়তি খাই।’
শুধুমাত্র অচাষকৃত উদ্ভিদ সংরক্ষণ করাই নয়, রিন্তী আক্তার জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ সংরক্ষণ করে বিশেষ অবদান রেখে যাচ্ছে। রিন্তী আক্তার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এবং পরিবেশ রক্ষায় ও বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় নিজ উদ্যোগে সংগঠনের কিশোরী সদস্যদের নিয়ে গ্রামের রাস্তার ধারে ও পতিত জায়গায় ৩০০টি তাল বীজ ও ১০০টি ফলের চারা রোপণ করেছে। এভাবে গ্রামের যুব ও কিশোরী সংগঠনগুলো পরিবেশ ও সংস্কৃতি রক্ষায় সংগঠিত হয়ে কাজ করে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে। ফলে গ্রামের কৃষি, পরিবেশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে যুব ও কিশোরীরা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে।