আলোর পথের পথিক

নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রানী সিংহ
যুগ যুগ ধরে সৃষ্টি হয়েছে তারুণ্যের জয়গান। আর জয়গানই একটি সমাজের বিকাশের সূচনা করেছে। তারুণ্য নতুন পথের সৃষ্টি করে, তারুণ্য নতুন কিছু আবিষ্কার করে। তাদের সাহস, মনোবল, স্পৃহা আমাদের সমাজের সম্পদ। আর এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সমাজের সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে গড়বে সমতার সমাজ।
আমরা এমনই একটি তরুণ সমাজের গল্প করবো আজ। নেত্রকোনা জেলার উত্তর বিশিউরা ইউনিয়নের পলাশহাটি গ্রামের তরুণদের গল্প। একটা সময় পলাশহাটি গ্রামে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ, শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক অবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। প্রায়ই এখানে ওখানে ঝগড়া বিবাদ, জুয়া খেলার প্রচলন ছিল বেশ। সেটা খুব বেশিদিন আগের কথা নয়; ২০১২ সালের দিকের কথাা।

আমরা জানি, তারুণ্যই পারে পরিবর্তনের সূচনা করতে। তারই ধারাবাহিকতায় পলাশহাটি গ্রামের কয়েকজন যুবক সমাজের এহেন পরিস্থিতি থেকে নিজেদের সমাজকে পরির্বতন করতে চেয়েছেন। ভাগ্যে আর পরিশ্রমের সাফেল্যে ২ জন তরুণ যখন উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায় সেখান থেকে ভাবনা আসে নিজের সমাজের পরির্বতনের। পরির্বতনের ভাবনাটা আরো কয়েকজন যুবকের সাথে সহভাগিতায় দল ভারি হতে শুরু করে।
দলের তরুণদের মধ্যেও ছোটবেলায় থেকেই বইপড়ার আগ্রহ থেকে একটা লাইব্রেরি করার স্বপ্ন বুনন করেছিল। আর সেটাকেই সমাজের পরিবর্তনের একটা মাধ্যম হিসাবে নিয়ে “নিজেকে গড়ে তোলেন এবং অন্যকে গড়তে সাহায্য করেন” এই শ্লোগানকে ধারণ করে বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে ওই গ্রামের তরুণরা। সবাই তখন ছাত্র। অর্থের যোগান দেয়া তাদের জন্য বেশ কঠিন ছিল। লাইব্রেরি গড়ার চিন্তাটা এলাকার সকলের সাথে আলোচনা করেন এবং সর্মথন পান। এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেনি অনেকে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত এবং সকলেরই বাশঁঝাড় আছে। তারা ঠিক করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাঁশ সংগ্রহ করে বিক্রি করবে। এভাবে কিছু অর্থের যোগান হয়। কিন্তু সেটা একটা ল্ইাব্রেরির অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে অপ্রতুল। তারপর তারা চুক্তিতে ধান কেটে অর্থের সংস্থান করে গড়ে তুলেন আলোর পথে পাঠাগার।


২০১৩ সালের ৮ জুন লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। নিজেদের সংগ্রহের বইগুলো স্থান পায় লাইব্রেরিতে। নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাহায়তায় নির্বাচনের পোষ্টারিং করে চা পানের টাকায় লাইব্রেরির আসবাবপত্র সংগ্রহ করে তরুণরা। প্রচার করতে থাকে তাদের লাইব্রেরীর কথা। বই চেয়ে আবেদন করে অনলাইন মাধ্যমে। এলাকার লেখকদের কাছ থেকেও কিছু বই সংগ্রহ করেছেন। নিয়মিত পেপার রাখার মাধ্যমে পাঠক ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু সদর থেকে গ্রামের অবস্থান বেশ দূরে থাকায় নিয়মিত পেপার পাওয়া ছিল একটা দৈনিক যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু না।


কিন্তু বই পড়ার পাঠক নেহাতি কম ছিল। এই নিয়ে ভাবনা বাড়ে তাদের। বই পড়ার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরিতে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করা, খেলাধুলার আয়োজন, কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা, জাতীয় দিবস উদযাপন, গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা সভা আয়োজন, বিনা মূল্যে বৃক্ষরোপণ, বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, রক্তদান কর্মসূচি, বর্ষাকালে গ্রামের কাঁচা রাস্তা সংস্কার ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তরুণরা। সমাজে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করতে থাকেন তারা। এলাকার অন্যান্য যুব সংগঠনের কার্যক্রমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামাজিক, পরিবেশ সংক্রান্ত, নদী রক্ষার সংহতি, যুব উৎসবে, প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থাকেন।


২০১৩ সালের পাঠাগারের সদস্যরা অনেকে এখন বাইরে থাকেন। কেউ চাকুরি সূত্রে বা লেখাপড়ার সূত্রে। যখন কেউ বাড়িতে আসেন তখন চেষ্টা করেন এলাকার ছেলেমেয়দের লেখাপড়া সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানের। পাঠাগারে চলে পড়াশুনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃত্তি পরীক্ষা, কোন প্রতিযোগিতা, কলেজে, বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা যাতে গ্রামের ছেলে মেয়েরা ভালো করতে পারে সেজন্য চলে স্পেশাল গাইড লাইন ও সহযোগিতা। করোনাকালীন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার গাইডলাইনের কাজটা আরো জোরালোভাবে করতে পেরেছেন।


গাইডলাইনের কাজটা এলাকায় অনেক গ্রহণযোগ্যতা পায়। সে সূত্রে আলোড়ণ নামে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কোচিং শুরু করে তরুণরা। সেখানে পাঠাগারের যে সদস্যরা এলাকায় থেকে পড়াশুনা করে তারা করায়। তাছাড়া বাইরে যারা থাকেন তারা এলাকায় আসার পর ক্লাস নেন। শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বাইরের পরিবেশ, সুযোগ, লেখক পরিচিতি, গ্রামীণ খেলাধুলা, মেধা বৃত্তি প্রদান, অভিভাবক সভা, ৩জন একই পরিবারের থাকলে একজন বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ, সাংস্কৃকিত অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন।


এর ধারাবাহিকতায় আলোরপথে বিদ্যানিকতনের সৃষ্টি হয়েছে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলোর পথের যাত্রী সৃজন করে। তাছাড়া পাঠাগারের জন্য ২.৫ শতক জমি কিনতে সক্ষম হয়েছেন তরুণরা। যদিও সেখানে এখনও পাঠাগারের কার্যক্রম শুরু হয়নি। মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে। গ্রামের মানুষের চিন্তা যেখানে বিদ্যালয়ে ছেলে মেয়েদের পাঠাবে কিনা সেখানে তাদের ভাবনা এখন কোন বিষয় নিয়ে তাদের সন্তানরা এগিয়ে যাবে। পাঠাগার স্থাপনের পর গ্রামের ১২ জন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে (ঢাবি, জাবি, শাবি), ১৫ জন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ, চাকরির সুযোগ পেয়েছে। মানুষের মধ্যে একত্রে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সমাজের মানুষের মধ্যে সহনশীলতা বেড়েছে। এলাকায় জুয়া, বাল্য বিয়ের মত ব্যাধিগুলো কমতে শুরু করেছে।
এই তরুণরা আশা করছেন তারা নিয়মিত পাঠচক্রের আয়োজন করবেন এবং নিজেদের গন্ডি পেরিয়ে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরবেন। তারা ‘থিংক গ্লোবালি, ওয়ার্ক লোকালি” এই নীতিতে কাজ করবেন।

happy wheels 2

Comments