নেত্রকোনার একটি সামাজিক ও মানবিক সংগঠন ‘রক্তের বন্ধন’
নেত্রকোনা থেকে রোখসানা রুমি ও রাজন
রাজন, রিয়াদ, সোহেল, মনির, শিহাব, মাহফুজ, লাবণ্য, মোশারফ, ইয়াসিন, আমানসহ বর্তমান প্রজন্মের যুব সমাজের বেশকিছ উদ্যমী যুবক মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের পাশে, যুবদের পাশে, প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দ্বারে এবং এলাকার সুবিধা বঞ্চিত অসহায় জনগোষ্ঠীর সাথে অসমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
যুগে যুগে যুবরাই দুর্যোগে, সংকটে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। হাতে হাত মিলিয়ে সংহতি ও ্ঐক্যের বন্ধন তৈরি করেছে, দেশকে ভালোবেসে নিজের শরীরের রক্তে বিলিয়ে দিয়েছে। যুবরাই ছিনিয়ে এনেছে জাতির জন্য লাল সবুজের পতাকা। তারাই জাগিয়ে রেখেছে পরিবার, সমাজ ও দেশকে, বাঁচিয়ে রেখেছে মানবিকতা, বৈচিত্র্য ও সভ্যতাকে। বর্তমান সময়ে এই যুব সমাজই বিভিন্ন অসামাজিক, অনৈতিক ও রাষ্ট্র বিরোধী অরাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পরিবার, সমাজ ও দেশের শান্তির পথে পপ্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার তথ্য আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রতিনিয়তই জেনে আসছি।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/05/received_460281361911694-W600.jpg)
নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের বালুয়াকান্দা গ্রামের এমনই কিছু সংখ্যক যুবদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ‘রক্তের বন্ধন’ যুব সংগঠন। সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য জীবন্ত ব্লাড ব্যাংক তৈরি করে মূমুর্ষু রোগীদের জীবন রক্ষার্থে বিনামূল্যে রক্ত দিয়ে সেবা করা। বিগত দুই বছর যাবৎ সংগঠনটি দরিদ্র ও অসহায় মূমুর্ষু রোগীদের বিনামূল্যে রক্ত দিয়ে আসছে। সংংগঠনটি স্বাধীনতার মাসে ও মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র সহযোগিতায় কাইলাটি উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে দিনব্যাপী এক রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ক্যাম্পের আয়োজন করে। এছাড়াও সংগঠনটি এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, পানির অপচয় রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব পানি দিবস উদ্যাপন, নতুন প্রজম্মের শিক্ষার্থীদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের গল্পের আসর ও কবিরাজ কর্মশালার আয়োজন করে। এলাকার প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে আয়োজন করে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ক্যাম্পের। যুবদের এই ধরণের মহতী উদ্যোগে সংহতি জানিয়ে প্রবীণদের জন্য আয়োজিত স্বাস্থ্য ক্যাম্পে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ঔষধ ও উপকরণ নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, নেত্রকোনা শাখা। সংগঠনটি যেখানে রক্তের প্রয়োজন সেখানে ছুটে যায় মূমুর্ষু রোগীকে রক্ত দিতে। সংগঠনের উদ্যোগে বিগত পাঁচ মাসে প্রায় ১০০ জন প্রবীণ রোগী, গর্ভবতী ও প্রসূতি মা এবং দূর্ঘটনাজনিত মূমুর্ষু রোগীকে বিনামূল্যে রক্ত দিয়ে সহায়তা করেছে। এছাড়াও বৈশ্বিক মহামারী করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সংগঠনটি স্বাধীনতার মাস থেকে (মার্চ) সংগঠনটি নিজস্ব উদ্যোগে বালুয়াকান্দা বাজারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং নিরাপদ দূরত্ব মেনে চলতে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে মাইকিং করে ও লিপলেটে প্রচারণা এবং বালুয়াকান্দা বাজারের থেকে নেত্রকোনা জেলা সদর পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশের প্রত্যেক দোকানীদের মধ্যে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করেছে। দোকানীসহ রাস্তায় যেসব পথচারীদের মুখে মাস্ক ছিলনা সংগঠনের সদস্যরা তাদেরকে মাস্ক পড়িয়ে দিয়েছে।
এলাকার এক দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধী ছেলে সন্তান জন্মের পর থেকেই বিচানায় শয্যাশায়ী, উঠা-বসা এমনকি হাত-পা ভালো করে সোজাও করতে পারে না। দরিদ্র পিতা রক্তের বন্ধন যুব সংগঠনের মানবতার সেবায় গৃহীত উদ্যোগের কথা শুনে ছুটে যায় বালুয়াকান্দা বাজারে সংগঠনের ঘরে, জানায় তার প্রতিবন্ধি শিশু সন্তানের সমস্যার কথা। সংগঠনের সদস্যরা সাম্প্রতিক সময়ে দরিদ্র অসহায় ঐ প্রতিবন্ধি সন্তানের পিতার অসহায়ত্বের প্রতি সাড়া দেয়। সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের উদ্যোগে প্রতিবন্ধি শিশুটির জন্য একটি হুইল চেয়ার দিয়ে সহযোগিতা করেছে। যুব সংগঠনের নিকট থেকে হুইল চেয়ার সহযোগিতা পাওয়ায় শিশুটিকে পরিবারের সদস্যরা চেয়ারে করে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারছে। শিশুটিও বিছানায় এক ঘেয়েমি পড়ে থাকার বিড়ম্বনা থেকে উদ্ধার পেয়েছে।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/05/received_364221321577461-W600.jpg)
কাইলাটি ইউনিয়নের কোন পরিবারে নতুন শিশু জন্ম হলে সংগঠনটি শিশুটির কাছে ছুটে গিয়ে ফলদ ও কাঠ জাতীয় গাছের চারা দিয়ে স্বাগত জানায়। শিশুটির পরিবারে সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের উদ্যোগে ২টি ফলের, একটি কাঠ ও একটি ঔষধি গাছের চারা রোপণ করে দিয়ে আসে। সংগঠনের সদস্যরা চলতি মাসে নিজেদের উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী গ্রাম রামপুর থেকে সাজনা গাছের ডাল সংগ্রহ করে দিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম দরুণবালিকে সবুজ গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে সমমনা ‘অক্সিজেন যুব সংগঠন’ ও ‘ফুল-পাখি কিশোরী সংগঠন’কে সহযোগিতা করেছে।
‘রক্তের বন্ধন’ যুব সংগঠনটি এলাকার যুব সমাজকে সকল প্রকারের মাদক দ্রব্য গ্রহণসহ অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখতে প্রতিদিন বিকেল বেলা ফুটবল খেলার আয়োজন করে থাকে। যুব পুরুষদের পাশাপাশি মাঝে মাঝে যুব ও কিশোরী নারীদের জন্যও সংগঠনটি ফুটবল খেলার আয়োজন করে থাকে। ফলে যুবদের পাশাপাশি এলাকার জনগোষ্ঠীও বিনোদন পাচ্ছে। ফুটবলের পাশাপাশি সংগঠনটি মৌসুমভিত্তিক ভলিবল, ষোলগুটি, দাবা, লুডু, মার্বেল, মির, মইলা প্রভৃতি গ্রামীণ খেলাধূলার আয়োজন করে থাকে। এভাবে সংস্কৃৃতির অন্যতম উপাদান গ্রামীণ খোলাধুলাগুলো চর্চার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সংগঠনটি কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। সংগঠনের সদস্যরা এলাকার সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোতেও শ্রম দিয়ে এবং গ্রামের রাস্তায় চলচলের সুবিধার্থে কালভার্টের সাথে রাস্তার সংযোগে স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কেটে ভরাট করে দিয়ে যোগাযোগে সহযোগিতা করছে। যুব সংগঠনের এই উদ্যোগুলো সুষ্ঠু যুব সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে এলাকাবাসী মনে করেন। সংগঠনটি এলাকার সকল যুবদের নিয়ে এলাকার উন্নয়নে পারস্পারিক আলোচনা, পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ এবং সৃজনশীলতার বিকাশে উন্নয়ন আড্ডার জন্য বালুয়াকান্দা বাজারে একটি অফিস ঘর স্থাপন করে সেখান থেকে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যুবসংগঠনটির এমন মহতি উদ্যোগ এলাকার সাধারণ জনগোষ্ঠীসহ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের নিকট ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
…………