করোনা ও অনাবৃষ্টি: খাদ্য সংকটের সম্মুখীনের পথে প্রান্তিক উপকূলীবাসী
সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে বিশ^জিৎ মন্ডল
‘আমরা কৃষক, আমরা মানুষ। কৃষি কাজই করে আমাদের জীবন চালাতে হয়। কৃষি কাজ বিহীন অন্য কাজই সেইভাবে করতে পারিনা। নিজেদের জমি জমা যেটুকু আছে সেখানে নানান ধরনের ফসল উৎপাদন করি। মাঝে মধ্যে অন্যের জমিতে কাজ করি। আর এ কৃষি কাজই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় কাজ। যেকোন মহামারী আসুক না কেন সব বাধাকে পিছনে ফেলে আমরা আমাদের এ কৃষি কাজ করে থাকি। কিন্তু এই কৃষি কাজ ও ফসল উৎপাদন সব কিছুর মূলে তো পানি। পানি ছাড়া কোন কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা খরার সন্মূখীন। এলাকাতে দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না হওযাতে পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। যেমন খাবার পানির সংকট, তেমন সেচ উপযোগী পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিযেছে। সব কিছু মিলিয়ে যেন পানি শুন্য জীবন চলছে আমাদের। কোন ফসলাদি চাষ করা যাচ্ছে না। নানানভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি তাও সম্ভব হচ্ছে না। পানি না হওয়াতে আমাদের ফসল চাষের পাশাপাশি নানান ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। গৃহস্খালির কাজ করতে পারছি না, ফসল ফলাতে পারছি না, পুকুর ও ঘেরের মাছ মারা গেছে, গবাদি পশু মারা গেছে, অনেক দুর থেকে এবং পানি ক্রয় করতে হচ্ছে, বাজারের উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। এছাড়াও বড় একটা আর্থিক ক্ষতির সন্মূখীনে পড়েছি।’ বিগত মাসে শ্যামনগর উপজলোর বিভিন্ন গ্রামে মাঠ পর্যবেক্ষণ ও যোগাযোগের মাধ্যমে শ্যামনগরের স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা এই কথা বলেন।
তারা জানান, বর্তমান যে করোনা মহামারী তার সাথে অনাবৃষ্টি যুক্ত হয়ে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান যেন বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে পাতিত হচ্ছে। করোনার কারণে যেখানে বাইরের কাজের সাথে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেখানেই কোন না কোনভাবে নিজের বসতভিটায় সবজি লাগিয়ে কিছুটা হলেও খাদ্য চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করেছেন অনেকে। তাতেও আবার খরা হানা দিয়েছে। একদিকে করোনা অন্যদিকে অনাবৃষ্টি মিলে যেন একটা খারাপ সময় পার করছেন তারা। এতে করে তারা খাদ্য সংকটের সন্মূখীন হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে ভুরুলিায় ইউনিয়নের কাচড়াহাটি গ্রামের কৃষানী তরুলতা গাইন বলেন, ‘আমার মোট দুই বিঘা জমি তার মধ্যে ৮ কাঠা বসতভিটা ও পুকুর। এই ভিটায যেমন প্রতিবছর নানান ধরনের সবজি চাষ করি। আর এক বিঘা ১২ কাঠায় দুই মৌসুমে ধান চাষ করি। এখানে যা ফসল উৎপাদন হয় তা সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে বড় একটা একটা অংশ বিক্রি করতাম, যা দিয়ে আমার সংসার ভালোভাবে চলতো। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে খুবি কম সবজি চাষ করতে পেরেছি। আর ধান তো আরো খারাপ অবস্থা। প্রতিবছর এই সময়ে এই জমিতে ৩০-৩৫ মণ ধান পেতাম। আর এবছর কোনরকমে প্রায় ১০ মণ ধান হয়েছে। এ ধান চাষে প্রায় ২২,৫০০ টাকা খরচ করেছি। যে টাকা সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে করেছি। এখন যেমন খাদ্যের অভাব দেখা দিচ্ছে তেমনি আবার ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন এই করোনার সময বাড়ির বাইরে যে কাজ করবো তাতেও বাধা। আগে যেমন যে কেউ কাজে নিতো এখন সেসব বাড়িতে প্রায় তারা নিজেরা কাজ করছেন। না পারছি ফসল ফলাতে না পারছি কাজ করতে। সবকিছু মিলিয়ে বড় বিপদের মধ্যে আছি আমরা।’
জয়নগর গ্রামের কৃষাণী রোজিনা বেগম বলেন, ‘পানির জন্য এলাকায় হাহাকার। পুকুরগুলো শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। যাদের একটু পানি আছে তারা কোন রকমে একটু সবজি চাষ করতে পেরেছেন। কিন্তু অধিকাংশ বাড়ি সবজি ক্ষেত ফাঁকা পড়ে আছে। আগে যেমন নিজের সবজি ক্ষেতের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানান ধরনের শাকসবজি তুলে দু’এক সাজের তরকারী হয়ে যেতো। এখন তাও হচ্ছে না! দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়াতে মাটিতে যেন লবণের মাত্রাও বেড়ে গেছে। একেিদক লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া অন্যদিকে তাপে গাছ মারা যাচ্ছে। এরকম যদি আরো কয়েক মাস চলে তাহলে এলাকায টিকে থাকা খুবই কঠিন হয়ে যাবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এবছর যেমন অনাবৃষ্টি হচ্ছে তা এর আগে কখনো দেখেনি। আমরা যেন এক অভিশাপের মধ্যে পড়েছি না হলে এরকম হবে কেন? একদিকে করোনার কারণে অনেকে কাজকর্ম হারাচ্ছেন অন্যদিকে এলাকায় পানির সংকটের কারণে খাদেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জানি না এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?’
বর্তমান সময়ে করোনা মহামারী ও অনাবৃষ্টিতে একাকার হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এতে করে যেমন অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন তেমনি নিজেদের বসতভিটায় ইচ্ছা করলেও ফসল ফলাতে পারছেন না। সবদিক থেকে যেন খাদ্য সংকটের সন্মূখীন হচ্ছেন এ এলাকার মানুষ। এ থেকে বের হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।