সাম্প্রতিক পোস্ট

করোনা দুর্য়োগে উপকুলীয় ভাটা শ্রমিকের আহা-জারি

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

একসময় বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকুলীয় এলাকায় নানান ধরনের ফসল চাষাবাদ হতো। প্রতিটি গ্রাম এমনকি প্রতিটি পরিবার দেখলে বোঝা যেতো যে সেই গ্রামে সেই বাড়িতে কত ধরনের প্রাণ বৈচিত্র্র্য আছে। আষাঢ়–শ্রাবণ মাসে সমস্ত কৃষি জমি ও বিলে দেখা যেতো হাজার হাজার মানুষ চাষাবাদের কাজ নিয়ে কতই না ব্যস্ত। আর এটা যাদের জমি আছে শুধু সেইই চাষাবাদ করতো না। যাদের নিজেদের জমি কম, এমনকি যাদের জমিও নেই- তারা নিজ গ্রাম ও পাশ্ববর্তী গ্রামের যার একটু বেশি জমি আছে তাদের ক্ষেতে কাজ করতো। আবার যাদের কম ছিলো তারাও একে অন্যেরটা শ্রম দিয়ে করে দিতো। আবার অনেক সময ধনী ব্যক্তিদের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করা হতো। এলাকায় ছিলো নানা ধরনের কাজ যেমন ধানের জমির বীজতলা তৈরি, জমি চাষ, ধান রোপন, ঘাস বাছা, গরু চরানো, কারো বাড়িতে মাইনে থাকা (যেটা সিজন চুক্তি বা বছর ভিত্তিক ভাবে থাকা), ধানের পাশাপাশি বসত ভিটায় নানান ধরনের মৌসুম ভিত্তিক ফসল চাষাবাদ হতো।আর এ সব কাজ ছিলো এলাকার মধ্যে। কখনও কাজ শেষে বাড়ি যাওয়া আবার যারা মাইনে থাকতো তারাও প্রয়োজন মত সময়ে বাড়ি যেতো সংসার পরিজনদের সাথে দেখাশোনা করতে। মাঝে মধ্যে অন্য এলাকার মানুষও এই এলাকায় কাজ করতে আসতো। সবাই এলাকার সব ধরনরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতো। সব কিছু হরহামেশাই করা হতো নানান আনন্দের মধ্যে দিয়ে।মানুষের মধ্যে ছিলো এক মেলবন্ধন।

কালের পরিক্রমায় যতই দিন যেতে থাকলো ততই যেনো এক ধরনের পরিবর্তন শুরু হতে লাগলো। বিশেষ করে ১৯৮০ দশকের পর থেকে উপকুলীয় এলাকার ওয়াপদা রাস্তা কেটে লবণ পানি উঠিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু হলে। এই সময়ে এলাকা ও এলাকার বাহিরের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নাম মাত্র কৃষকের জমি হারি (লীজ) নিয়ে এ কাজ শুরু করেন। আর এটি প্রবল ভাবেবিস্তার ঘটতে শুরু করেছিলো ১৯৯০ দশকের পর থেকেই। আর সেখান থেকে এটি ধারাবাহিক ভাবে বছরে বছরে বাড়তেই আছে। আর এতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে ভূমিহীন এবং স্বল্প জমির মালিক, বিভিন্ন ধরনের দরিদ্র পেশাজীবী যারা অন্যের ক্ষেতে জন-মজুরী দিতো। এলাকায় কাজের অমিল (সংকট) দেখা দেওয়া শুরু করলো। যেখানে ১০ বিঘা ধানের জমিতে ৫ জন কাজ করতে পারতো সেখানে ১০ বিঘা  চিংড়ি ঘেরে ১জন হলে চলে যায়; তাও আবার নিজ জমির মালিক। এলাকায় কাজের জন্য মানুষের মধ্যে হাহাকার শুরু হতে লাগলো।

আর সেখান থেকে উপকুলীয় এলাকার মানুষ বিশেষে করে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার মানুষ বাধ্য হয়ে বাইরের এলাকায় ধান কাটা ও ইট ভাটার কাজে ঝুঁকে পড়ে। আর ঝুঁকে পড়া দিনকে দিন বাড়তেই আছে। কোন কোন পরিবারের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান মিলে বাইরে কাজে যাচ্ছে। আর বাইরে কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ইটের ভাটার কাজ। এখানকার স্থানীয়রা মনে করে যে, এই কাজটি আমরা আমাদের আয়ের অন্যতম উপায় মনে করি। কারণ এই কাজে ৬ মাসে আমাদের বড় একটা আয় হয। যা দিয়ে বাকি ৬ মাস এলাকায় যেকোন কিছু করে চলে যায়।

ইট ভাটায় শ্রমিকেরা কাজ কষ্টের হলেও তারা এটাকে উত্তম কাজে বলে মনে করতেন। কিন্তু বর্তমান সমযের সবচেয়ে আলোচিত যে বিষয় তাহলো মহামারী করোনা ভাইরাস। যার জন্য গোটা বিশ্ব আজ হুমকির মুখে। প্রতিনিয়ত যেনো বিশ্বের অবস্তা পরিবর্তন হচ্ছে। আর এ পরিবর্তন হচ্ছে বাঁচা মরা নিয়ে। কোন দেশে কতো জন মরছে, কতো জন আক্রান্ত হচ্ছে তা নিয়ে। দেশেরে অর্থনৈতিক চাকা যেনো থমকে আছে। কারণ যে শ্রমিকেরা শ্রম দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল করতো তাদের আজ হাত-পা বন্দী; ঘরে বসে আছে।পুরো দেশ এমনকি পুরো পৃথিবী যেনো এক লকডাউন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলছে। সমস্ত কলকারখানা, অফিস বন্ধ ঘোষনা। দেশে এক অরাজকতা, এক মহামারী দেখা দিচ্ছে। যেখানে ইট ভাটার শ্রমিকেরা এই করোনা শুরু হওযার আগে থেকে তারা বাড়ি ছেড়ে ভাটার উদ্দেশ্য কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। আর এই যাওয়া শুরু হয়েছিলো তাদের অধিকাংশই বাংলায় কাত্তিক মাস থেকে। এখান থেকে প্রায় ছয় মাস অর্থাৎ বৈশাখ মাস পর্য়ন্ত ৬ মাসের চুক্তিতে আবদ্ধ হোন। আর এই কাজ করতে করতে শেষ পর্য়ায়ে তারা করোনার আক্রোশের শিকার হোন। যেখানে আরে দেড় দুমাস কাজ করলে তাদের চুক্তির সব টাকা বুঝিয়া পাওয়ার কথা সেখানে তারা এই করোনার ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেও তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।এতে করে ইট ভাটা শ্রমিকের মধ্যে এক ধরনের আহাজারি শুরু হয়েছে বলে তারা জানান।

এবিষয়ে জয়নগর গ্রামের মুজিবর গাজী বলেন, আমি প্রতিবছর ভাটায় কাজ করতে যাই। আমাদের এলাকাতে অধিকাংশই জমি চিংড়ি ঘের তেমন কোন কাজ নেই এলাকাতে। আমাদের এই কাশিমাড়ি ইউনিয়নে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ পরিবার এই কাজের সাথে যুক্ত। এখানে অনেক পরিবার আছে যেখানে কোন পরিবারে ২ জন ৩জন ৪ জন পর্য়ন্ত আছে। আর এ কাজে তাদের স্ত্রী, সন্তান ও নিজেরাই যুক্ত। এবছর আমি ৬ মাসের জন্য ১লক্ষ ১৫ হাজার টাকার চুক্তিতে আবদ্ধ হই। সেখানে বর্ষার কারণে ৭ দিন কাজ বন্ধ ছিলো বাকী দিনগুলোতে কাজ করেছি। এ পর্য়ন্ত টাকা পেয়েছি ৬২ হাজার বাকি টাকা কবে পাবো তা জানিনা। আর এ সব হয়েছে এই করোনার কারণে। এতে করে বড় ধরনের একটি ধাক্কা খেতে হবে।

অন্যদিকে সৈয়দালিপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমি ও আমার ছেলে এবছর ৬ মাসের জন্য ২ লক্ষ ৩৫ হাজার চুক্তিতে ইট ভাটার কাজে ভোলায় যাই। এখানে আমাদের এলাকার প্রায় ১৫০ জন লোক ছিলো। কযেক দিন হচ্ছে আমরা খুবই কষ্ট করে বাড়িতে এসেছি নদী পথে। করোনার এই দুর্য়োগ নিযে আমরা কাজ করেছিলাম। কাজ শেষে আমাদের এখনো ৮০ হাজার টাকা বাকি আছে। সরদার দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে দেওয়ার কথা বলেছে। এদিকে অগ্রীম নেওযা টাকার অধিকাংশ খরচ হয়ে গেছে সমিতির ঋণে ও মেয়ের বিয়ের জন্য। আবার সামনে রমজান মাস। একদিকে যেমন এলাকাতে কাজও নেই। আবার থাকলেও তা বাহিরে যেতে পারবো না। ভাটা থেকে যা হাত খরচের টাকা নিয়ে এসেছি তাতেও আর কতদিন চলবে। সব কিছু মিলেয়ে করোনা কালে আমাদের দুর্দিন আসতে চলেছে।

ইট ভাটার কাজ কষ্টের ও ঝুকিপূর্ণ কাজ হলেও তারা এটি করে। কারণ এলাকাতে কাজের সংকট থাকাতে তারা বাধ্য হয় বাহিরে যাচ্ছে। আর এ শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত তাদের শ্রম বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমান সমযে করোনা দুর্য়োগ এই শ্রমিকের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা তাদের সঠিক শ্রম দিযেও তাদের ন্যয্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা করছে। প্রতিটি দেশের চালিকা শক্তি যেখানে শ্রমজীবিরা তারাই শ্রম দেয় বলেই আমরা এতো আরাম আয়েশে থাকতে পারি। তাদেরই টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে বর্তমান সমযে। তাই সেসব শ্রমিকদেরকে এই করোনা ক্রান্তিকালে তাদের পাশে থাকা, তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে পাওয়া এবং এই হাহাকার রোধের উপায় বের করা জরুরী। সাথে সাথে তাদের শ্রমিক ভাতা সুনিশ্চিৎ ব্যবস্থা করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

happy wheels 2

Comments