নদী নগর ও সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে
পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
পানির প্রাকৃতিক ধারক নদী আমাদের অস্তি¡ত্ব এবং ঐতিহ্য। বাংলাদেশ নদীর দেশ হলেও এ দেশের অনেক নদ নদী আজ প্রাণ হারিয়েছে। অনেক নদ নদী প্রাণ হারাবার পথে। একটা নদ বা নদী যখন প্রাণ হারায় বা হারাতে বসে তখন নদী পারের মানুষের জীবনে পরে তার বিরূপ প্রভাব। নদীর উপর নির্ভর করে একটা এলাকার কৃষি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের অগ্রগতি। যুগে যুগে বিভিন্ন নদী পাড়ে গড়ে উঠেছে নগর সভ্যতা। নদী সমৃদ্ধ করেছে এসব নগর ও সভ্যতাকে।
পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই জল হলেও ব্যবহার ও পানোপযোগি জল নিয়ে বিশ্বব্যাপী রীতিমতো দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অনেক দেশই প্রবহমান নদীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে জল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ভাটির দেশগুলোকে বঞ্চিত করছে। নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উজানের কিছু দেশ ভাটির দেশের প্রয়োজনের সময় জল না দিয়ে নিজেরা ব্যবহার করায় বাড়ছে বৈষম্য। কেবল বহির্দেশ নয় আমাদের দেশেরও কিছু অসাধু মানুষের অপতৎপরতা দখল দূষণ নদীকে নিজ স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতার ফল হিসেবে আমরা আমাদের কিছু নদী হারিয়ে ফেলছি। দেশী অথবা বিদেশী যাই বলি না কেন এখানে দৃশ্যত দু’টি শ্রেণী বিদ্যমান। একটি শ্রেণী পানিকে নদীকে কেবল নিজের দেশ অথবা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে; নদীকে গলা টিপে হত্যা করছে। আরেকটি শ্রেণী নদীর পানি সুষম বণ্টনের জন্য লড়াই করছেন এবং দখল দুষণ থেকে মুক্ত করে নদীকে প্রবহমান করার চেষ্টায় সব সময় লিপ্ত রয়েছেন।
প্রসঙ্গতঃ পাবনা শহরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদী আজ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এ চার জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বড়াল নদী দখল দূষণের ফলে নদীপাড়ের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইছামতী ও বড়াল এ নদী দুটো আজ মৃত প্রায়। উভয় নদী এখন আর পানি ধারণ করে না।
এ নদী দুটো এখন কচুরিপানা, বর্জ্য, ময়লা আবর্জনার ধারক ও মশক উৎপাদনের স্থানে পরিণত হয়েছে। দখল দূষণ নাব্যতা সংকট নদীর বুকে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে এ নদী দুটো যখন মরতে বসেছে এমন সময় পাবনার সচেতন মানুষ নদীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে নদী দুটো দখলদার মুক্ত, দূষণ মুক্ত করতে, নদীর পানি প্রবাহ চালু করতে গত কয়েক বছর যাবত মিছিল মিটিং সমাবেশ করে আসছেন। বড়াল নদী চালু করার দাবিতে ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন করেছে বড়াল নদী পাড়ের মানুষ। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। ভাষার জন্য মিছিল করতে গিয়ে মানুষ যেমন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাধীনতার জন্য যেমন মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন তেমনি প্রতীকি হলেও পাবনার মানুষ ইছামতি নদী রক্ষায় গত ৪ মে শনিবার কাফনের কাপর পড়ে নদী দখল দূষণ বন্ধ করতে নদীকে প্রবহমান করতে ঐক্যবদ্ধভাবে দৈনিক সিনসা পত্রিকা সম্পাদক মাহবুব আলমের নের্তৃত্বে দাঁড়িয়েছেন নদী পাড়ে। একই দিনে চাটমোহরে বড়াল নদী পুনরুদ্ধারে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ। সরকারের বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিসহ রাজশাহী নাটোর পাবনা ও সিরাজগঞ্জের নদী প্রেমীরা এ সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, বাপা, বিপিআই, ও বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সহযোগিতায় বড়াল নদী রক্ষা বিষয়ক এক বিরাট সমাবেশে এ দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘নদীকে গুটি কতক লোক দখল করবে তা আমরা চাই না। নদী রক্ষার জন্য আজ সারা দেশে আন্দোলন গড়ে উঠছে। উন্নয়নের নামে নদী খাল বিল জলাশয় দখল করা যাবেনা।’ তিনি বড়াল নদী পুনরুদ্ধার করতে পাবনার জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনকে বিশেষভাবে নজর দিতে বলেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে পাবনার জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মোঃ আলাউদ্দিন, এশিয়ান প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ইন্টারন্যাশনাল রিভার সমীর মেহেতা, বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ড পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল হক, চাটমোহর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ¦ আব্দুল হামিদ মাষ্টার, চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার অসীম কুমার, বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান, চাটমোহর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রভাষক ফিরোজা পারভীন, জেলা পরিষদ সদস্য হেলাল উদ্দিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
একই মিলনায়তনে সকালে অঞ্জন ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় বড়াল নদী কনভেনশন। এসময় পানি উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহীর তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আমিরুল হক ভুইয়া, পানি উন্নয়ন বোর্ড পাবনার তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম, এ এসপি চাটমোহর সার্কেল সজীব শাহরীন, চাটমোহর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রভাষক ফিরোজা পারভীন, অধ্যক্ষ আব্দুর রহিম কালু, বড়াল আন্দোলন কমিটির নেতা বাগাতি পাড়ার আবু হানিফ, ফরিদপুরের হাফিজুর রহমান, তাড়াশের আব্দুর রাজ্জাক রাজু, রায়গঞ্জের দিপক কুমারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। কনভেনশন ও সমাবেশে বক্তব্য প্রদানকারীরা এ নদী দুটো উদ্ধারে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।