দূর্যোগ মোকাবেলায় তাল বীজ রোপণ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক কারণে বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়, অকাল বন্যা, খরা, মানুষসহ সকল প্রাণী ও ফসলের নিত্যনতুন রোগবালাই, ফসলের কোল্ড ইঞ্জুরি, অতিবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টিপাত ও বজ্রপাতসহ বিভিন্ন দূর্যোগ। এসব দূর্যোগে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ অবলম্বন করে আসছে বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি ও কৌশল। সৃষ্টি করছে বিভিন্ন ধরণে উপায় এবং উদ্ভাবন করছে নতুন নতুন কৌশল। অন্যদিকে দূর্যোগের ধরণের মধ্যেও বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে বজ্রপাত একটি বড় দূর্যোগ হয়ে দেখা দিয়েছে। বৈশাখ মাস থেকে সারা বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পূর্বে বজ্রপাত হবে এবং বিদ্যুৎ চমকাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত দেখা যায় বজ্রপাতের ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত কয়েক বছরে প্রায় শতাধিক লোক বজ্রপাতে মারা যাবার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। পরিবেশবিদ এবং এলাকার অভিজ্ঞ প্রবীণদের মতে, ‘দেশে বড় বড় গাছ (উঁচু) না থাকার ফলে বজ্রপাত সরাসরি মাটিতে আঁচড়ে পড়ায় মানুষসহ গবাদি পশু-পাখি মারা যাচ্ছে। বজ্রপাতের মত দূর্যোগ থেকে মানুষসহ গবাদী পশু-পাখি রক্ষায় পরিবেশবিদগণ তাল জাতীয় উঁচু বৃক্ষ রোপণের পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারও সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ, রাস্তার ধারে, পতিত জায়গায় উঁচু হয় এমন গাছ, যেমন- তাল গাছ রোপণের নির্দেশ দিয়েছেন। বিগত তিন চার বছর ধরে দেশব্যাপী মানুষ তাদের সামর্থ অনুযায়ী রাস্তার ধারে ও পতিত স্থানে তাল বীজ রোপণ করে আসছেন।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়ন সমাজকল্যাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সহযোগিতায় ফচিকা অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন, লোহা লক্কর কর্মকার নারী সংগঠন, বালুয়াকান্দা যুব সংগঠন এবং আব্বাছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে দূর্যোগ প্রশমন দিবস উপলক্ষে ইউনিয়ন পরিষদ হল রুমে এক আলোচনা সভা আয়োজন করে। আলোচনায় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও কমিটির সদস্যসহ প্রায় ৫০ জন লোক অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনার ফলে অংশগ্রহণকারীরা দূর্যোগের বিভিন্ন করাণ (জলবায়ু পরিবর্তনজনিত, মানুষ সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ) এবং দূর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। আলোচনা শেষে দূর্যোগ প্রশমন দিবস উপলক্ষে ইউনিয়ন সমাজকল্যাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, জনসংগঠনের উদ্যোগে সংগৃহীত ২০০টি তালের বীজ নেত্রকোনা-কেন্দুয়া রোডের বালুয়াকান্দার থেকে জিনজিননিয়া (পুল) ব্রীজ পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তায় ধারে রোপণ করা হয়। এছাড়াও নিজ নিজ বাড়িতে রোপণের জন্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আরও ১০০টি তাল বীজ বিতরণ করা হয়। তাল বীজ রোপণ অনুষ্ঠানে কিশোরী সংগঠন, নারী সংগঠন ও যুব সংগঠনের সদস্য এবং স্থায়ী কমিটির ৭ জন সদস্যসহ সাধারণ জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেন।
এই প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ইউনিয়ন পরিষদ সচিব আব্দুল কাদির বলেন, ‘এলাকায় গাছপালা কেটে ফেলায় এবং বড় বড় গাছ না থাকায় প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। এর ফলে দেশে বজ্রপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, বজ্রপাতে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক লোক ও অনেক গবাদি পশু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। পরিবেশের ভারসমাম্য নষ্ট হওয়ায় বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সন্মূক্ষীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে অন্তত দু’টি করে গাছ লাগাই ও তাল বীজ রোপণ করে পরিবেশকে রক্ষা করি।’
ইউনিয়ন পরিষদ দূর্যোগ কমিটির সদস্য খোকন মিয়া বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ গাছ কাটছি তার অর্ধেক পরিমাণও গাছ লাগাইনা। আমাদের এলাকায় উুঁচ গাছ নাই বললেই চলে, তাই আমাদের প্রত্যককে তাল, খেজুর, সুপারি, নারিকেল ইত্যাদি গাছ রোপণের প্রতি নজর দিতে হবে। কেননা উঁচু গাছ বজ্রপাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। তাই আসুন আমরা সকলে মিলে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করি, বজ্রপাত থেকে বাঁচি’।
বাংলাদেশ প্রকৃতিনির্ভর একটি দেশ। তাই প্রাকৃতিক দূর্যোগ অবসম্ভাবী। মানষ সৃষ্ট কারণে যাতে দূর্যোগের পরিমাণ বৃদ্ধি না পায় সেজন্য আমাদের সকলকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রশমনে দেশের সকল পতিত জায়গায়, রাস্তার ধারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৈচিত্র্যময় গাছ বিশেষভাবে তাল জাতীয় গাছ রোপণ করতে হবে। গাছ আমাদের প্রাকৃতিক বন্ধু, গাছ আমাদের ছায়া দেয়, বেঁচে থাকার রসদ অক্সিজেন যোগায়, ঝড় ও বজ্রপাতসহ নানান প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা করে এবং প্রাণবৈচিত্র্যকে রক্ষা ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই বজ্রপাতসহ সব ধরণের দূর্যোগ প্রশমনে ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় পতিত সকল খালি জায়গায় তাল বীজসহ বড় বড় গাছের চারা রোপণ করতে হবে এবং বেশি করে গাছ লাগাতে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। সকলের যৌথ উদ্যোগই পারে মানুষসহ সকল প্রাণকে দূর্যোগ থেকে রক্ষা করতে। কাইলাটি ইউনিয়ন পরিষদ সমাজকল্যাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ন্যায় দেশের সকল ইউনিয়নের কমিটিগুলোকে বৃক্ষ রোপণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বজ্রপাতসহ সকল প্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দূর্যোগ মোকালো করে টিকে থাকা সম্ভব হবে, রক্ষা পাবে মানুষসহ সকল জানমালের।