শরিফুলের পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলা
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
“১৮ বছর থেকে ফুটপাতে চায়ের ব্যবসা করি, মাটি দিয়ে চুলা তৈরি করি, প্রায় দিনে সকালে এসে দেখি ভেঙে গেছে, মাটি দিয়ে আবার লেপতে হতো প্রতিদিন। প্রতিদিন ভাবি, কিভাবে এমন চুলা তৈরি করা যায় যেটি ভাঙবে না এবং জ্বালানিও কম লাগবে। এভাবে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে আমি একটি চুলা তৈরি করি যার নাম দিয়েছি ম্যাজিক চুল। এই চুলায় রান্না করে ভালো ফল পেয়েছি। আগের চুলায় যেখানে বেশি জ¦ালানি লাগতো, লাভ কম হতো, ধোয়াও বেশি উঠতো সেখানে এই নতুন চুলায় জ্বালানি কম লাগতো, ধোঁয়াও হয় কম।” উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন চা স্টলের ব্যবসায়ী মো. শরিফুল ইসলাম (৪৫)।
রাজশাহী শহরের বিভিন্ন ফুটপাতে, রাস্তার ধারের চায়ের স্টলগুলোতে এখন ব্যবহার হচ্ছে ম্যাজিক চুলা বা শিখ চুলা। এই ম্যাজিক চুলা স্থানীয় চা ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনের খাতিরেই নিজের বুদ্ধি দিয়েই তৈরি করেছেন। ম্যাজিক চুলা প্রথম কে তৈরি করেছিলেন এ বিষয়ে তেমন কোন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় যায় না। তবে চায়ের ব্যবসায়ীরা একজনের কাছ থেকে আরেকজন প্রয়োজনেই শিখে নিয়েছেন এই চুলা তৈরির কৌশল। এভাবেই একজনের অভিজ্ঞতা আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে ম্যাজিক চুলার সম্প্রসারণ ঘটেছে গোটা শহরময়। এই ম্যাজিক চুলাকে অনেকে শিখ চুলা বলেও জানেন। বিভিন্ন চায়ের স্টলে এই চুলার ব্যবহারের গুণাগুণ ও তৈরির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো নওদা পাড়ার বাস-ট্রাক টারমিনালের উত্তর পার্শ্বে মো. শরিফুল ইসলামই এই ম্যাজিক চুলা বা শিখ চুলার প্রথম আবিষ্কারক। তিনি নিজেও এটা দাবি করে বলেন, “আমি এই চুলা প্রথম তৈরি করি, পরে ধীরে ধীরে গোটা শহরে এই চুলার সম্প্রসারণ ঘটে।”
ম্যাজিক চুলার আবিষ্কারক শরিফুলের কথা:
মোঃ শরিফুল ইসলাম। থাকেন নওদাপাড়া বাস টারমিনালের উত্তর পার্শ্বে। সবসময় চিন্তা করেন নিজে নিজেই বুদ্ধি আর রোজগার করে কিভাবে চলা যায়। পারিবারিক অভাবের কারনে লেখা পাড়া করতে পারেননি। বর্তমান তাঁর ০৭ সদস্যের সংসার । ছোট্র একটি চায়ের দোকান দিয়েই চলে, তাঁর বেশী চাওয়া পাওয়ারও ইচ্ছা নেই । তাঁর ভাষায়-“ কোন মতে ডাল ভাত হলেই যথেষ্ট আর ছেলে মেয়েকে লিখা পড়া করাতে পারলেই আমি সুখী।” কিশোরকাল থেকেই রাজশাহীর বিভিন্ন ফুটপাতে চায়ের ব্যবসা করেন। নিজের সামান্য বাড়িভিটা ছাড়া আর কোন জমি জমা নেই তাঁর। ফুটপাতের দোকানই তাঁর একমাত্র ভরসা। চা , বিস্কিট আর কলা বিক্রি করেই তিনি দিনে ৫০০- থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। এর মধ্যে থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই সংসার চলে।
ম্যাজিক বা শিখ চুলার গুণাগুণ
শরিফুলের মতে, এই চুলা জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। কোন ধরনের ধোঁয়া হয় না। সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চারিখোল (তুষ দিয়ে তৈরি এক ধরনের লাকড়ি) লাগে মাত্র ৪৫ টাকার। চারিখোল বিশেষ ধরনের এক প্রকার জ্বালানি যা তুষ দিয়ে লাকড়ি আকারে তৈরি করা হয়। অনেকে এই জ্বালনিকে চারিখোল বলেন। কিছু মানুষ আছে যারা এই চারিখোল তৈরি করে বিভিন্ন চায়ের দোকানে বিক্রি করেন। এই চুলা একইসাথে জ্বালানি এবং অর্থ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। আবার এটি তৈরিতে যেসব উপকরণ লাগে তা স্থানীয়ভাবেই পাওয়া যায়। এই চুলা তৈরির উপকরণ ও কারিগড়ি কৌশল স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকায় এর ব্যবহার দিনে দিনে বাড়ছে। এই চুলা ব্যবহার করে চায়ের এবং হোটেলের দোকানদারগণ লাভবান হচ্ছেন। রাজশাহীর ভদ্রা মোড়ের চায়ের দোকানদার দুলাল মিয়া এই প্রসঙ্গে (৫০) বলেন, “এই চুলা ব্যবহারের পর থেকে আমার লাভ বেশি হয়, আগে খড়ি (জ্বালানি) বাবদ খরচ হতো দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, আর এখন রাতে দিনে খরচ হয় মাত্র ৪০ থেকে ৬০ টাকা।” মেজিক চুলা তৈরির কারিগড় শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমার যেরকম আগুণ (উত্তাপ) দরকার আমি সেরকমই পাবো, যে পরিমাণ চারিখোল দিবো, সেই পরিমাণই জ্বলবে। আগে মেশিনের মধ্যে কেরোসিন তেল দিয়ে পাম্প (বাতাস) করে চুলা জ্বালাতে হতো, এতে কোরোসিন তেল বেশি পুড়তো, বারবার কাজ বাদ দিয়ে পাম্প দেবার কারণে শরীরের শক্তি এবং সময় নষ্ট হতো। কিন্তু মেজিক চুলা ব্যবহারের ফলে এসব আর করতে হয় না।” ধান ছাঁটাই করে চাল তৈরির পর যে ছোবড়া (তুষ) থাকে তা দিয়েই এই চুলায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, “এই চুলা ব্যবহারে অধিক লাভ এবং খরচ কম হয়।
ম্যাজিক চুলা তৈরির উপকরণ ও পদ্ধতি
এই চুলা তৈরিতে যেসব উপকরণ প্রয়োজন হয় তা হলো: আড়াই কেজি চিকন লোহার রড়, লোহার নেট পরিমাণমত, তিনফুট বা আড়াই ফুট উচ্চতার প্লাসটিক পাইপ, সমউচ্চতার চিকন একটি কলার গাছ বা চিকন পাইপ, যেটি নল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। কিছু ইটের খোয়া, দুই কেজি সিমেন্ট। এই চুলা তৈরির ক্ষেত্রে খাঁচা তৈরি করে ইট, বালি সিমেন্ট একসঙ্গে মিশিয়ে ঢেলে দিতে হয়। শুকানো বা জমাট বাঁধার পর কলার গাছের টুকরোটি বের করে ফেলে দিলেই হয়ে গেলো মেজিক চুলা। এটি ইচ্ছেমত যেকোন জায়গায় বসিয়ে চায়ের কেটলির পানি গরমে বা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। শরিফুলের মতে, “কংক্রিটের এই মেজিক চুলা তৈরি করতে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ পড়বে।” এটি আবার একই কায়দায় মাটি দিয়েও তৈরি করা যায়। তখন এর খরচ আরো কম পড়বে বলে তিনি জানান। শরিফুলের মতে, দেখা যায় রাজশাহীর শহরে বেশির ভাগ দোকানিরা মাটি দিয়েই এই মেজিক বা শিখ চুলা তৈরি করেন। তিনি বলেন, “এই চুলা তৈরিতে চুলার সাইজের উপর টাকা খরচেরও একটা বিষয় আছে। বড় সাইজের মেজিক বা শিখ চুলা তৈরিতে করতে ৫০০- ৬০০ টাকাও লেগে যায়। এটি সাধারণত বড় দোকানগুলোতে লাগে।”
শরিফুলের ইচ্ছা-স্বপ্ন
শরিফুল মনে করেন, জ্বালনি সাশ্রয়ী এবং আর্থিকভাবে বেশি লাভ করা এই মেজিক বা শিখ চুলা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যাক। এটি ব্যবহার করলে মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমবে, একই সাথে ব্যবসায় লাভ বেশি করতে পারবে। এই চুলা বাড়িতেও রান্নার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, “এই চুলা তৈরি করা একদম সহজ এবং এটা তৈরি করতে যেসব উপকরণ লাগে তা হাতের নাগালের কাছেই আছে।”